বিএনপি এখন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল ও অঙ্গসংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর প্রতি এ নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এদের সঙ্গে নতুন করে আরও কিছু যোগ হয়েছে। এই অদৃশ্য শক্তি ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। দেশের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। নিজেরা অঘটন ঘটিয়ে, মব তৈরি করে বিএনপির ওপর দোষ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে যুবদল কর্মী সোহাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই তার প্রমাণ। এই ভয়ানক বর্বরোচিত ঘটনার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতার সংশ্লিষ্টতার ছবি ও তথ্য ভাইরাল হচ্ছে। অথচ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্লিপ্ত। এসব অপরাধ ‘মব’ সন্ত্রাস আর নোংরা রাজনৈতিক চর্চার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। বিএনপি সরকারকে সহযোগিতা করছে এবং করে যাবে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ডে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই তারা পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে দোষারোপ করে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল বের করেছে। সেখানে বিএনপি এবং তার শীর্ষনেতাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এ ধরনের পরিকল্পিত আরও ভয়ংকর ঘটনা সহসাই তারা ঘটাতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এই আশঙ্কা থেকেই বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এসব মব, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার ও অপপ্রচার থেকে রক্ষা পেতে এবং সরকারের নির্লিপ্ততায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দুই দিনের বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই আসছে কেন্দ্রীয় বিএনপির নতুন কর্মসূচি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে, মৃত্যু বাড়ছে। দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিচ্ছে, কারণ তাদের পেছনে জনগণের সমর্থন নেই। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার এলে নিঃসন্দেহে সেটা শক্তিশালী সরকার হবে। তখন আমরা নিশ্চয়ই সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ থেকে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন করে একটা নির্বাচন দ্রুত চাই। কারণ গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন নেই বলে আজ দেশে এই অঘটনগুলো ঘটছে। তবে এসব অপকর্মের ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।’
এসব বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “দলের কারও বিরুদ্ধে কোনো রকমের খারাপ অভিযোগ আসামাত্রই তার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা আমাদের পক্ষে যেটুকু সম্ভব তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থাটুকু নিচ্ছি। আমাদের হাতে তো আর প্রশাসন, পুলিশ কিংবা জুডিশিয়ারির মতো কোনো ক্ষমতা নাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো সরকারের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। তবে যে কোনো ঘটনা ঘটলেই কোনো কোনো মহলের বিএনপির ওপর তার দায় চাপানোর যে একটা প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা তো একটা অপরাজনীতি। এটা হলো নোংরা রাজনীতির চর্চা। আমরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েই আছি।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘রাজধানীর মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত ছিল তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? তাদের নাম কেন মামলার এজাহার থেকে বাদ দেওয়া হলো? আমাদের দলের কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বলে তো এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু মামলার এফআইআরে নাম আসার কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর অ্যাকশন নিয়েছি। দল থেকে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির মেয়ে সাক্ষাৎকারে বলেছে, তাকে মামলার আবেদনে স্বাক্ষর করতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সে স্বাক্ষর করেছে। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের কাউকে এই মামলায় আসামি করা হয়নি, কেন? এগুলো সবই বিতর্কিত বিষয়। আমরা যা বলতে পারি তা হলো, একজন মসজিদের ইমাম সাহেবকে মসজিদের ভিতরে কোপানো হয়েছে। তার আগে খুলনাতে যুবদলের একজন ছেলেকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হলো। সে বিষয়ে তো কেউ সোচ্চার কোনো প্রতিবাদ করছে না। কুমিল্লার একটি বিষয়ে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপিকে দোষারোপ করা হলো। কিন্তু পরে দেখা গেল যে এটি কোনো রাজনৈতিক বিষয়ই নয়। দুই ভাইয়ের অন্তঃকলহের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, সে বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। আসলে এগুলো হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে নোংরা অপপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার একটা অপরাজনৈতিক চর্চা। এমন অবস্থায় আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, যেন নিরপেক্ষভাবে কঠোর হস্তে এসব অপরাধ দমন করে।’
এসব বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যখনই কোনো অভিযোগ আসছে তখনই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক স্থানে আইনানুগ ব্যবস্থা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। কাউকে কোনো রকমের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমরা দেখছি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ সর্বস্তরের জনগণকে এখনই সচেতন হতে হবে। সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সংকট তৈরির নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যখন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেন, তখনই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড, তখনই এই বিব্রতকর অবস্থা। হত্যাকাণ্ডসহ এসব অঘটনের সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে হবে। এখন খুঁজে বের করতে হবে, মিটফোর্ডের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল হোতা কে? তিনি এসব হত্যাকারীসহ রাজনৈতিক ফায়দা লুণ্ঠনকারীদের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন ও সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
যুবদলের কর্মসূচি : সরকারের নির্লিপ্ততায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে এবং দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামী বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় নয়াপল্টনে বিক্ষোভ মিছিল। একই দিনে সারা দেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
ছাত্রদলের কর্মসূচি : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আজ সোমবার (১৪ জুলাই) বেলা ২টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এদিন সারা দেশের সব জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল করবে ছাত্রদল।
বিএনপিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না : বিএনপিকে এত সহজে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘তারেক রহমান দ্যা হোপ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি বারবার প্রমাণ করেছে ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকে জেগে উঠতে পারে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পরে অনেকেই ভেবেছিল বিএনপি শেষ। বিএনপিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই বিএনপি আবারও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ছাত্র ও যুবনেতাদের সঙ্গে নিয়ে জেগে উঠেছে। বড় পরিসরে জাতীয়তাবাদীদের সাইবার যুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএনপির ওপর পরিকল্পিতভাবে সাইবার হামলা করা হচ্ছে। এবার বাদ যাননি তারেক রহমানও, যা খুবই উদ্বেগজনক। এখন যে আক্রমণ করা হচ্ছে তা খুবই পরিকল্পিত চক্রান্ত। এ সময় তারেক রহমানের ওপর দীর্ঘ নিপীড়নের পরও আপসহীন মনোভাবের কথা তুলে ধরেন ফখরুল। তিনি বলেন, আজকে যে অপপ্রচার হচ্ছে, এর পেছনে সুনির্দিষ্ট চক্রান্ত রয়েছে। সেই চক্রান্ত হলো বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া। তারেক রহমানের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহর সভাপতিত্বে ও কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহিদ উর রহমান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদি আমিন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থসহ বিএনপি মতাদর্শের অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ব্লগাররা বক্তব্য দেন।