২০১২ সালে, লস অ্যাঞ্জেলেসের হলিউড হিলসে হঠাৎ করেই ক্যামেরায় ধরা পড়ল এক বিশালাকৃতির পর্বতের সিংহ। ওজন ছিল প্রায় ৪১ কেজি (৯০ পাউন্ড)। পরে গবেষকরা জানালেন, এটি একটি ১.৫ বছর বয়সী পুরুষ পিউমা, যার নাম দিলেন পি-২২ (পি মানে পুমা)। সে একাই প্রায় ৪৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দুটি বড় হাইওয়ে পার হয়ে পৌঁছায় গ্রিফিথ পার্কে—যা হলিউডের পাশেই অবস্থিত।
পি-২২ দ্রুতই লস অ্যাঞ্জেলেসের 'সেলিব্রিটি প্রাণী'তে পরিণত হয়। কিন্তু তার জীবনের বাস্তবতা ছিল নিঃসঙ্গতা—অন্য কোনো পাহাড়ি সিংহ থেকে বহু দূরে বিচ্ছিন্ন। জীবনসঙ্গীর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
সংকট থেকে সম্ভাবনা
ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ ফেডারেশনের ক্যালিফোর্নিয়া আঞ্চলিক পরিচালক বেথ প্র্যাট প্রথম যখন পি-২২–এর কথা জানেন, তখনই বুঝতে পারেন বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। জেফ সিকিচ নামক এক জীববিজ্ঞানীর মাধ্যমে তিনি জানেন, শুধু পি-২২ নয়, সান্তা মনিকা পর্বতমালার অনেক পর্বতের সিংহও হাইওয়ের কারণে বিচ্ছিন্ন ও ইনব্রিডিংয়ে আক্রান্ত।
একটি পূর্ণবয়স্ক পাহাড়ি সিংহের বিচরণক্ষেত্র ৬৫০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের সড়কব্যবস্থা তাদের আটকে রেখেছে, এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আশার নাম—‘ওয়ালিস অ্যানেনবার্গ ওয়াইল্ডলাইফ ক্রসিং’
এই সংকট থেকে সমাধান দিতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী চলাচল সেতু—ওয়ালিস অ্যানেনবার্গ ওয়াইল্ডলাইফ ক্রসিং। এটি ২০২৬ সালে চালু হওয়ার কথা। দৈর্ঘ্যে ৬৪ মিটার ও প্রস্থে ৫৩ মিটার এই সেতুটি ১০১ হাইওয়ের ওপর নির্মিত হচ্ছে। এতে থাকবে মরুভূমি অঞ্চলের মতো প্রাকৃতিক টেরেইন, গাছপালা ও পাথর। মূল লক্ষ্য, সান্তা মনিকা পর্বতমালার দুই পাশে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা।
এই উদ্যোগের নেপথ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী পল এডেলম্যান, যিনি ১৯৮৯ সাল থেকেই এই পরিকল্পনায় যুক্ত। তিনি সরকারি ও বেসরকারি জমি ক্রয় করে প্রায় ৪৩৯ একর জমি সংগ্রহ করেন, যা সেতুর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে।
প্রাণ বাঁচানোর লড়াই
২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় ৬১৩টি পাহাড়ি সিংহ গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছে। শুধু ১০১ হাইওয়েতেই প্রতিদিন ৩ লাখের বেশি গাড়ি চলে, যা বন্যপ্রাণীদের জন্য ভয়াবহ।
এই সেতু শুধু প্রাণীদের জন্য চলার পথই নয়, বরং দাবানলের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেও কাজ করবে। ২০১৮ সালের ভয়াবহ উলসিলি দাবানলে ৯৬,৯৪৯ একর এলাকা পুড়ে গিয়েছিল। দুটি সিংহ আগুন থেকে পালালেও পরে অপুষ্টি ও পুড়ে যাওয়া পায়ের কারণে মারা যায়।
পি-২২ এর জনপ্রিয়তা ও চাঁদা সংগ্রহ
পি-২২ এর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বেথ প্র্যাট এক বিশাল তহবিল সংগ্রহ করেন। ‘LA’s loneliest bachelor’ নাম দিয়ে একটি ইনস্টাগ্রাম পেজ খোলা হয়, যার ১৫ হাজারের বেশি অনুসারী ছিল। একে নিয়ে তৈরি হয় ‘ঘোস্ট ক্যাট’ ওয়াইন, ক্রিসমাস সোয়েটার, লাইব্রেরি কার্ড। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ৬ হাজারের বেশি ব্যক্তি অর্থ দিয়েছেন।
এই উদ্যোগে ১০ কোটি ডলার সংগ্রহ করা হয়, যার অর্ধেক এসেছে ব্যক্তি অনুদান থেকে। অনুদানদাতার মধ্যে ছিলেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও বারবারা স্ট্রেইস্যান্ডের মতো সেলিব্রিটিরাও।
মৃত্যুর আগের দিন…
২০২২ সালের ডিসেম্বরে পি-২২ আচরণগত পরিবর্তন দেখাতে শুরু করে। পরে জানা যায়, সে বিষক্রিয়ায় ভুগছিল এবং সম্ভবত গাড়ির ধাক্কাও খেয়েছিল। তাকে ঘিরে যত স্বপ্ন বোনা হয়েছিল, শেষবার বেথ প্র্যাট তার মুখোমুখি হন, কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলেন, “তোমার জন্যই এই আন্দোলন। শুধু একটা নয়, আরও অনেক সেতু হবে—তোমার কারণে।”
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/আশিক