হাড়গিলে পাখির বিচরণদৃষ্টে চিকনদেহী মানুষকে ওই পাখির সঙ্গে তুলনা করার বাতিক রয়েছে কারও কারও। বহু বছর আগে রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় ‘সিটি মেডিকো’ নামধেয় ওষুধের যে দোকানে প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় সবান্ধব আড্ডা দিতাম, সেই আড্ডার মারমুখো সদস্য শরাফত আসগর ওই রকম এক বাতিকগ্রস্ত। বলতেন, ছিলি হাড়গিলে ঘটনাক্রমে হয়েছিস টিয়ে পাখি। আওয়াজ কম দে। লাফালাফি করলে আছাড় খেয়ে লুলা হয়ে যাবি রে খোকা।
আড্ডায় অনুপস্থিত সৈয়দ জাকির আলীর উদ্দেশে এই স্টাইলে বাণ ছুড়তেন শরাফত। জাকিরের সামনাসামনিও বলতেন, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় অখণ্ড বাংলায় বাঁকা রাস্তায় ধনরাশি করায়ত্ত করা ফকিন্নির পোলাদের অনেকে জাতে ওঠার জন্য নামের সঙ্গে খান-সৈয়দ-চৌধুরী ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিয়েছে। আপনি কি সেরকম সৈয়দ বংশীয় হুজুর আলা?
ঝুঁকিপূর্ণ প্রশ্ন! আড্ডায় মুড়ি-পিঁয়াজু-ডালপুরি-চা খাওয়ার খরচ প্রায়শ বহন করেন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার সৈয়দ জাকির আলী। শরাফতের ব্যবহারে জাকির রুষ্ট হয়ে গেলে ব্যাপারটি আমাদের আর্থিক ক্ষতিসাধন করতে পারে। জাকির অবশ্য কখনো রাগেননি। তিনি ঠান্ডা মাথায় বলতেন, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। সৈয়দ ফ্যামিলি অশোভন কথার অশোভন জবাবদানে অভ্যস্ত নয়।
জাকিরের বাড়ি যে জেলায় আমারও সেখানে। আমার শহুরে বাড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে নরোত্তমপুর গ্রামে জাকিরের বাড়ি। শরাফত শুনতে পেয়েছেন, জাকির উপরে যেরকম ভিতরে তার উল্টো। তাই তিনি তদন্তে যাবেন নরোত্তমপুর। ইতিহাস বের করে আনবেন। তাঁর বিশ্বাস, ইতিহাস উন্মোচনের দ্বারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠার অভিযান অগ্রগামী হয়।
গ্রামে গেলেই ইতিহাস পাবেন ভাবছেন? শরাফত বলেন, অবশ্যই পাব। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের জন্য মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে দেখুন কেউ সাড়া দেবে না। কিন্তু যে-ই বলবেন ‘গোমর জানতে চাই, জানাবে?’ অমনি ইতিহাস দেওয়ার জন্য চারদিক থেকে দাতারা ছুটে আসবে। শরাফতের পাল্লায় পড়ে ১৯৮৭ সালে নরোত্তমপুর যেতেই হলো।
জাকির আলী সাহেবের বাড়ি কোন দিকে? জানতে চাইলে গ্রামের এক মুদি দোকানি বলেন, জাকির তো তিনজন। কোন জাকিররে খুঁজতেছেন। কারে দরকার?
তিনজনকেই চিনেন? জানতে চান শরাফত আসগর। দোকানি তাঁর উত্তর দিকে ডান হাতের তর্জনী প্রসারিত করে বলেন, ওই যে জামরুল গাছ দেখতেছেন তার পিছনে তিরিশ কদম গেলেই কুমড়া জাকিরের বাড়ি। এরপর দক্ষিণ দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, খাজুর গাছ দেখতেছেন দুইটা? পাশেই টিনের ঘরে থাকে কানকাটা জাকির। আর পশ্চিম দিকে যে খাল দেখেন, খাল পারাইয়া মসজিদ পাইবেন। মসজিদের ডাইন দিকের বাড়ি জোগালি জাকিররার।
আমরা খুঁজছি (রাজধানীর ব্যবসাদার) প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার জাকির আলীর বাড়ি। দোকানি শোনাচ্ছেন কুমড়া-কানকাটা- জোগালিবৃত্তান্ত। ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, এ সময় ডাল-তেল কেনার জন্য এলেন দাড়িমুখ এক প্রৌঢ়। বাড়ি খোঁজার কথা জানতে পেরে তিনি বলেন, ‘ঠিক জাগাতেই আইছেন যে। জোগালি জাকিররাই তো ঢাকায় গিয়া বিরাট কনটেকদার অইছে। বাড়ি খোঁজেন কিয়েল্লাই? হ্যাতার কাছে টিঁয়াটুঁয়া (টাকাপয়সা) পাইবেননি কোনো? যদি পাওনাদার হইয়া থাকেন টিঁয়ার আশা বাদ দেন জনাব। আমনের তিন পুরুষ ধইরা চ্যাষ্টা কইরলেও ফুটা পয়সা উদ্ধার করতে পারবেন না। ধাপ্পাবাজের ওস্তাদ ধাপ্পাবাজ জাকিররা।
দাড়িমুখ লোকটাকে ‘মজন চাচা’ বলে সম্বোধন করছে দোকানি। তাঁর প্রকৃত নামটি জানার ফুরসত পেলাম না। কেননা তথ্য জানাতে উদগ্রীব মজন চাচা আর মুদি দোকানি পালাক্রমে ইতিহাস উদগিরণ করে চলেছেন। তা থেকে জানা গেল যে সৈয়দ বংশীয় প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারটি উচ্চস্তরের অমানুষ। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করার সময় গৃহস্থের সিমেন্ট-রড চুরির দায়ে তিনবার সাজা হয় তার। তৃতীয় দফা কারামুক্তির পর সে রাজধানীতে হিজরত করে। সিনেমার টিকিটের কালোবাজারিতে নামার সুবাদে অপরাধের বিভিন্ন শাখায় হাত পাকায়। এখন জাকির আলীর অঢেল সম্পদ। প্রতি বছর শীতকালে বাড়ি এসে দানখয়রাত করে। তবে পুরোনো অভ্যাস যায়নি। চাকরি জোগাড় করে দেবে আর মালপানি খাওয়ার ফিটিং জায়গায় বদলির বন্দোবস্ত করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষের টাকাকড়ি লোপাট করে চলেছে।
খাল পেরিয়ে জোগালি জাকির আলীর বাড়িতে পৌঁছাই আমরা। বাড়ির সামনে সবজি খেত থেকে বেগুন তুলছে ফতুয়া ও লুঙ্গি পরা এক যুবক। নাম ফরিদ, সম্পর্কে জাকির আলীর চাচাতো ভাই। খেতের লাগোয়া টিনের ঘরটি বৈঠকখানা। ফরিদ আমাদেরকে ওই ঘরে নিয়ে বসায় এবং দুপুরের খাবারের আয়োজন শুরু করে। আমরা জানাই যে অন্যত্র দাওয়াত আছে, সেখানে খাব। আসলে এ বাড়ির সেবা এড়ানোর মতলবেই এমন যুক্তি। ফরিদ বলে, আমনেরা জাকিভাইয়ের দোস্ত, না খাইয়া গেছেন শুনলে উনি রাগ করবেন। আমরা বলি, ওনাকে বুঝিয়ে বোলো। আলাপের একপর্যায়ে শরাফত আসগর জানতে চাইলেন, বাড়িতে দোতলা দালান কয়টি? ফরিদ জানায়, উঠোনের তিন দিকে ছয়টি টিনের ঘর। একতলা দলানই তো নাইক্কা দোতলা থাকবে ক্যামতে!
‘শুনি ঘিয়ে রাঁধা হালুয়ার বড়াই/দেখি তিন ফুটোঅলা লোহার কড়াই।’ অস্ফুট উচ্চারণ করেন শরাফত আসগর। নিঃশব্দে তিনি হাসেন। ফরিদ বলে, ভাইজান কি কিছু কইলেন? শরাফতের উত্তর : ‘তোমারে না। নিজেরে কয়েছি।’
কেন কইলেন? কওয়ার কারণ, জাকির আলী বুক চিতিয়ে একদা ঘোষণা করেছিলেন যে তার বাড়ির উঠোনের তিন দিকে তিনটি দোতলা দালান। তাদের বাড়িতে যারা মিন্তি পদে কাজ করে অবসরে গেছে তাদেরকে তার বাপ-দাদারা সাত বিঘা করে জমি দান করেছেন। তার বাবার আপন ভাই ও চাচাতো ভাইয়েরা বাঘা বাঘা আমলা। ফুফুদের বিয়ে হয়েছে কলেজ-ভার্সিটির অধ্যাপকদের সঙ্গে। ইউরোপ-আমেরিকায় পাকাপাকি বাস করছে জ্ঞাতি ভাইবোনেরা।
খাল পেরোনোর সাঁকো পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল ফরিদ। এ সময় ওর সঙ্গে ছিলেন শমসের নামে জাকিরের এক চাচা। লোকটা জরাগ্রস্ত; খুকখুক কাশছিলেন অবিরাম। তাকে বললাম, এ বাড়ির যারা ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশে বাস করেন তারা বছরে কবার আসেন। শমসের বলেন, হায়রে আল্লাহ! জাইক্কা দেখি আমনেগোরেও হাতিঘোড়া দরিয়া দিঘির ভেলকি দ্যাখাইয়া ছাড়ছে। আরে বাবা আমাদের বংশ হইল এক্কেরে মাজুর মার্কা হাইল্লা চাষা বংশ। উপাস হয়তো আমরা থাকি না। সেজন্য তিন বেলা দুধ ক্যালাবাতাসা খাই কইতে পারি? আংগো বাড়ির পোলাপান ঢাকা-চিটাগাংয়ে চারকি করতে পারলে আল্লার বিরাট রহম হয়। হ্যারার ইরুপ-আমরিকা যাওনের খোয়াব দ্যাখনের ক্ষমতাও তো নাই।
ফরিদ ও শমসেরের বর্ণনামতে, গত ৪৫ বছরে এ বাড়ির পাঁচটি ছেলে এসএসসির চৌকাঠ অতিক্রম করতে পেরেছে। এদের মধ্যে ইন্টার পাস শুধু জাকির আলী। তার চাচা শমসের জানান, জাইক্কা মাইনষেরে কয় হ্যাতে এমএ পাস। কয় তার শইল্লে খানদানি রক্ত টগবগ করতেছে। কয় জজ ব্যারিস্টার মন্ত্রী মিনিস্টার সব তার হাতের মুডায় ধরা। হ্যার কামকাজে বদবু আর বদবু। দুর্গন্ধ ঢাকনের জন্য চোপাবাজি দিয়া আতরের কাম সারতে চায়। হ্যার হইল উপরে উপরে আতর আর ভিতরে ভিতরে কাতর অবস্থা।
শমসেরের কয়েকটি জিজ্ঞাসা আমাদের চমকিত করে। তিনি বলেন, উঁচা খানদান আর নীচা খানদান নিয়া এত্তো মাথা ঘামান লাগে ক্যান? মরি গেলে উঁচা খানদাইন্নাগোরে কি সাত আসমানে নিয়া দাফন করবে? নীচা কন আর উঁচা কন মাটির নিচে না যাইয়া কি পার পাবে?
এ ধরনের প্রশ্নাবলি সুদূর অতীতেও নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাতে ‘মোদের লোহু নীল’ মর্মে বড়াই করবার নেশায় মত্ত হওয়া থামেনি। রাজত্বে যেমন ওই নেশার চর্চা, দাম্পত্যেও। মনে পড়ে ছোট্ট শিশুর সেই প্রশ্ন, যেখানে সে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, আমরা কি বানর থেকে আস্তে আস্তে বহু বছর পর মানুষ হওয়া শুরু করেছি? মা বলেন, কে তোমায় এ কথা বলেছে। শিশুটি বলে, বাবা। তখন মা বলেন, কি জানি বাপু! তোমার বাবার পূর্বপুরুষদের কারও সঙ্গে তো আমার দেখা হয়নি। খাঁটি আর্যের রক্ত জার্মান শরীরে- এই অহংকার হিটলারকে উন্মাদ করেছিল। তাঁর ধারণা ছিল, অনার্য সেমেটিক ইহুদিরা জার্মানিকে কলুষিত করছে। এই অভিযোগে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী।
প্রাচীন গ্রিসেও রক্তের বড়াই জোরদার ছিল। এটা একটুও সইতেন না দার্শনিক ডায়োজেনিস (জন্ম : খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪০৩-মৃত্যু : খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২৩)। তাই বংশের আভিজাত্য ত্যাগ করে, প্রাসাদের বাইরে সাধারণ একটা ঘরে বাস করতেন তিনি। গোসলখানার লম্বা গামলা (বাথটাব) ছিল তাঁর ‘খাট’। এতেই শুয়ে রাত কাটাতেন। এই মহাপণ্ডিতের গভীর অনুরাগী ছিলেন মহাবীর আলেকজান্ডার। এক সকালে তিনি দেখেন, বাড়ির আঙিনায় বেশ কিছু নরকঙ্কাল নাড়াচাড়া করছেন ডায়োজেনিস!
‘এরকম করছেন কেন গুরুদেব?’ জানতে চান আলেকজান্ডার। জবাবে ডায়োজেনিস বলেন : তোমার বাবার আর তাঁর দাসদের কঙ্কাল রয়েছে এখানে। অনেক চেষ্টা করছি তবু রাজার হাড্ডি আর দাসের হাড্ডি আলাদা করতে পারছি না। পারব কেন! সব হাড্ডিই তো একই রকম।
লেখক : সাংবাদিক