সৃষ্টির চেয়ে আনন্দের পৃথিবীতে আর কিছু নেই। হোক সেটা ছোট কিংবা বড়, নশ্বর কিংবা অবিনশ্বর, মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন, সাধারণ কিংবা অসাধারণ। একটা ছোট শিশু যখন পরম যত্নে কাগজ দিয়ে নৌকা তৈরি করে তখন সৃষ্টির এই আনন্দ তার চোখে মুখে ফুটে উঠে।
বিস্ময়ের ঘোর তার হৃদয়কে আন্দোলিত করে যায় খুব নীরবে, নিভৃতে, নিঃশব্দে। হয়তো সেটা বোঝার মতো বয়স তার হয়নি, কিন্তু জীবনের কোনো না কোনো চিন্তাশীল একটা জায়গায় সেটা রেখাপাত করে যায় খুব গভীরভাবে। যেন বিশ্বজয় করা এক রূপকথার রাজপুত্র হয়ে উঠে সে। কে এটাকে ছোট বলে উপহাস করলো, কে এটাকে মূল্যহীন ছাইপাশ বলে নিন্দা করলো সেটা তার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ হলো তার সৃষ্টি। যে সৃষ্টির রং গায়ে মেখে সে বর্ষার থৈ থৈ পানিতে কাগজের নৌকাকে ভাসিয়ে খেলার আনন্দে মগ্ন হয়ে থাকবে।
এভাবে নশ্বর থেকে অবিনশ্বর সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয়। কারণ এমন বিন্দু বিন্দু করেই যে চিন্তার জন্ম হয় সেটাই একদিন চিন্তার জগতে মহাবিপ্লব ঘটিয়ে সৃষ্টিকে মহাসৃষ্টিতে পরিণত করে। এবার খুব অনুভূতি জাগানিয়া সৃষ্টির কথা বলবো। একটা গর্ভবতী মায়ের কথা ভাবুন। সন্তান তার গর্ভে। যতই দিন যায় মা ততই তার ভিতরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করে। প্রাণে আনন্দের দোলা লাগে। চাঁদের হাসির বাঁধ যেন ভেঙে যায়। গর্ভের সন্তান যখন পেটের ভিতরে মৃদুমন্দ বাতাসের মতো নড়ে উঠে তখন মায়ের মন সৃষ্টিকে অনুভব করে। সে অনুভবের আবেগমথিত অনুভূতি মায়ের কাছে কতটা বড়, কতটা মূল্যবান সেটা পৃথিবীর আর কেউ না বুঝলেও মা বুঝতে পারে। জীবনের ভিতর অদৃশ্য জীবনের বেড়ে উঠাটা যদি এতটা আনন্দের হয়। তবে সে সন্তান যখন মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীতে তার পদচিহ্ন একে দেয় তখন সে আনন্দ কতটা বিরাট হয়ে মহাবিস্ময়ের জন্ম দেয় তা বোধ হয় সে মা ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না।
এবার চাষাভুষা মানুষের সাদামাটা সৃষ্টির কথা বলবো। একটা জেলে কত পরম আনন্দে জাল বুনে। সুতোর পরে সুতোর নিখুঁত ভাঁজ দেয়। অলসতায় আক্রান্ত উদোম দেহটা গাছের শক্ত কাণ্ডের উপর হেলে রেখে সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠে। একটা নগণ্য জেলের এই সৃষ্টির আনন্দের মূল্য পৃথিবী জানে না, সে জেলেটা জানে। কারণ সে জানে জালটা বুনতে পারলেই সে উত্তাল নদীতে গিয়ে মাছ ধরতে পারবে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তবে এই জালে মাছ আটকালে তার পরিবারের মুখে সে খাদ্য তুলে দিতে পারবে।
ক্ষুধার যন্ত্রণা যাদের প্রতিদিনের সঙ্গী তাদের কাছে এই খাদ্যটা কিনতে পারাটাই একটা সৃষ্টি যা পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানের সৃষ্টির আনন্দের চেয়ে অনেক অনেক বড়। আর ভাগ্য যদি বিরূপ হয়, তবে ক্ষুধার যন্ত্রনায় তার পরিবারের জীবনের লড়াইটা তার কাছে একটা সৃষ্টি। জীবনের সাথে লড়াইটা যত যন্ত্রণার হয়, জীবনবোধের গভীর থেকে জীবনকে দেখতে পাবার উন্মাদনাটা ততটাই আনন্দের হয়।জীবনকে সবাই দেখতে পারেনা, যারা জীবনকে জীবনের ভিতর থেকে টেনে এনে সৃষ্টি করতে পারে তারাই জীবনকে প্রানভরে দেখে। এটা এক অলৌকিক আনন্দের মতো। যেটা জেলের মতো চাষারা জীবনের রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে বুঝে ভদ্র বেশভূষার মহাপণ্ডিতরা বড় বড় বইয়ের ছাপা অক্ষরের লেখা পড়ে বুঝে না।
হরিপদ কাপালী না পড়েছেন বড় বড় লেখকের বই, না জানেন বিজ্ঞান। অথচ অক্ষরজ্ঞানহীন দরিদ্র এই মানুষটা হরিধান নামে নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবক। নতুন সৃষ্টির জন্য শিক্ষিত হতে লাগে না, একটার পর একটা কাগজ উল্টিয়ে বই পড়ার প্রয়োজন হয় না, খুব দামি ল্যাবরেটরির প্রয়োজন নেই, ইন্টারনেটের তথ্য ভান্ডারেও মূল্য নেই যদি নিজের কাজের গভীরে ঢুকে অচেনাকে চেনার মতো একটা মন থাকে। সে মনে হরিপদ কাপালীর মতো একটা সাধারণ মানুষ বাস করলেই চলে।
বড় ইট পাথরের দালান কোঠায় থাকা সভ্য পৃথিবীর মানুষেরা বৃষ্টির মর্ম কতটা বুঝে যতটা বুঝে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত অসভ্য মানুষটা। একটা সাধারণ হাবাগোবা মানুষের ইটপাথরের ঘর থাকেনা, তার মাথার উপর থাকে কম দামি টিনে আচ্ছাদিত ছাদ। সে ছাদে যখন মেঘ থেকে বৃষ্টির পতন ঘটে তখন সেখানে যে অনিন্দ্য শব্দের মূর্ছনা তৈরী হয় তা কেবল ঐ ছা'পোষা মানুষটাই বুঝতে পারে আর অন্য কেউ নয়। কান থাকলেই সবাই সেই বৃষ্টির অমৃত সমান শব্দকে শুনতে পায়না বরং যাদের প্রকৃতিকে দেখার মতো সৃষ্টিশীল চোখ থাকে তারাই সেখানে সেতারের সুরে বেজে উঠা শব্দকে সৃষ্টি করতে পারে। এটা সাধারণ মানুষের এমন এক মহামূল্যবান সৃষ্টি যা কিনতে টাকা লাগেনা, ক্ষমতা লাগেনা, পদপদবি, প্রভাব প্রতিপত্তি লাগেনা অথচ কৃত্রিম জলধারা বানাতে নিয়ে বড় বড় মানুষের অনেক অনেক টাকা লাগে। আবার সে টাকার উপর মানুষের লোভের চোখ পড়ে। কৃত্রিম জলধারার যে মেকি আনন্দ তা কখনো বৃষ্টির জলধারায় যে অভূতপূর্ব সৃষ্টি ঘটে সে আনন্দের চেয়ে বড় হতে পারে না।
খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি বড় বড় ভদ্র মানুষেরা মিছে মরীচিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে টাকা উড়ায়, টাকার মোহে অন্ধ হয়ে যায়। সে অন্ধ মন প্রাচুর্য খুঁজে, মানুষ খুঁজে না। সেখানে সৃষ্টির আনন্দ থাকে না, বাণিজ্যিক বাজারের বড় বড় মানুষের পণ্যে পরিণত হবার মতো ঘটনা থাকে।
এক সময় রাজা-মহারাজা-জমিদাররা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজপ্রাসাদে নর্তকী রাখতো। রাজারা ভাবতো নর্তকীদের তারা কিনে ফেলেছে, তাদের দাসে পরিণত করেছে। পেটের দায়ে নর্তকীদের রাজা মহারাজাদের আনন্দ দিতে হয়েছে, মন ভরাতে হয়েছে। অথচ নর্তকীদের মোহে পড়ে রাজারাই যে তাদের বশীভূত হয়ে দাসত্ব বরণ করেছে। তা রাজারা কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি। কারণ অন্ধ আসক্তিতে অবরুদ্ধ মন কখনো মুক্ত চিন্তা করতে পারে না। মনস্তত্বের ভিতরের দর্শনতত্ত্বকে সৃষ্টি করতে পারে না।
অন্যদিকে রাজমহলের বিলাস বৈভবে কাঠের পুতুলের মতো রাজাদের রানীরা মনের কষ্ট বুকে চেপে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে। তাদের আক্ষেপ তারা রানী হয়ে তার রাজাকে ধরে রাখতে পারেনি। অথচ মুক্তচিন্তা মাথায় নিয়ে কখনো রাজাদের এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেনি। হয়তো রানী হয়ে থাকবার লোভ, নয়তো ভয়। যদি এ কথা বলতে গিয়ে রাজা আর রাজা না থেকে রাক্ষস হয়ে যায়। রাজপ্রাসাদের প্রহরীর মনস্তত্ব এই ত্রিমাত্রিক টানপোড়েনের একটা সমীকরণ হয়তো তৈরি করেছে তবে একটা সাধারণ প্রহরীর সৃষ্টির কি কোনো মূল্য আছে। রাজপ্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্যে হয়তো সেই সৃষ্টির বিয়োগান্ত আনন্দ মাথা চাপড়ে মরেছে, তবে মুক্তির পথ খুঁজে পায়নি। সেই যাপিত সময়ে প্রহরীর সেই সৃষ্টি মূল্য না পেলেও ইতিহাস তাকে মূল্য দিয়েছে।
বিজ্ঞানের সৃষ্টিতে প্রমাণ লাগে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লাগে, যুক্তি লাগে। অথচ সাধারণ মানুষের অসাধারণ সৃষ্টিতে এর কোনোটাই লাগে না। এটাই এই সৃষ্টির অমিত শক্তি যা যে কোনো শক্তিকে পরাভূত করতে পারে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত