বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বহুমাত্রিক ও জটিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনের অস্থিরতা, মতাদর্শিক বিভাজন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে জাতি অগ্রসর হয়েছে। এই ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ দর্শনের ভিত্তিতে বিএনপির আত্মপ্রকাশ ঘটান।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, যা কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং বহুমুখী জাতীয় উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ উন্মোচন করে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ প্রথম কয়েক বছর গভীর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, খাদ্যসংকট ও দারিদ্র্য, অন্যদিকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক চর্চার সংকোচন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামরিক অভ্যুত্থান—এসব পরিস্থিতি দেশের জনগণকে নতুন বিকল্পের সন্ধানে ঠেলে দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণা সামনে আনেন।
তাঁর মতে, জাতির পরিচয় শুধু ভাষাভিত্তিক নয়, বরং ভূখণ্ড, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এই দর্শন আওয়ামী লীগের প্রচলিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ থেকে আলাদা এবং অনেকটা সময়োপযোগী বলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর দলটি দ্রুত সংগঠিত হয়। কয়েক বছরের মধ্যে এটি বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের একটিতে পরিণত হয়।
প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য : বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে আওয়ামী লীগ কার্যত একক প্রভাব বিস্তার করছিল। বিএনপি জন্মের মাধ্যমে দ্বিদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়, যা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়। বিএনপি জাতীয় পরিচয়ের নতুন ব্যাখ্যা দেয়, যেখানে ভাষার পাশাপাশি ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভূখণ্ডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে সাধারণ মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বেশি সম্পৃক্ত বোধ করে। ১৯৭৫-৭৮ পর্যন্ত দেশে কার্যত একদলীয় শাসন ছিল।
বিএনপি প্রতিষ্ঠা ও বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন জনগণকে আবারও গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনে।
রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে দলটি গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সংগঠন বিস্তার করে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা বাড়ায়, যা রাজনীতিকে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে যায়। বিএনপির নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন কূটনৈতিক মাত্রা পায়। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়, যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে সহায়ক হয়। জাতীয় উন্নয়নে বিএনপির অবদান অপরিসীম। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় বিএনপির অবদান অপরিসীম। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। সেই সরকারই রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিএনপি সংসদীয় কাঠামোতে বিরোধী দলের অবস্থানকে মর্যাদা দেয়। বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বেসরকারি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিএনপির শাসনামলে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও স্থানীয় উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো হয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে বিএনপি সরকার অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেয়।
বেসরকারি খাতের প্রসারে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উৎসাহিত করা হয়, যা শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করে। তৈরি পোশাক শিল্পে নীতি সহায়তা প্রদান করা হয়, যা আজ দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত। প্রবাসী শ্রমিকদের উৎসাহিত করতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কৃষি উন্নয়নে সেচ, সার ও প্রযুক্তি সহজলভ্য করে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভিত্তি গড়ে তোলা হয়। অবকাঠামো উন্নয়নে বিএনপির শাসনামলে একাধিক বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বিএনপি মহাসড়ক উন্নয়ন (ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। গ্রামীণ রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। শিক্ষায় উপবৃত্তি কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে সক্ষম হয়। মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করে নারীশিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে বিএনপি। উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট ছিল বিএনপি। কারিগরি ও ভোকেশনাল বা কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তারে তৎপর বিএনপি বহু কারিগরি ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। কূটনৈতিক সফলতা অর্জনে বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি ছিল বাস্তববাদী। মুসলিম বিশ্বে সম্পর্ক দৃঢ়করণের অংশ হিসেবে সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ছিল বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির বড় সফলতা। সার্কে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য সহায়তা বৃদ্ধি বিএনপির দূরদর্শী রাজনীতির পরিচায়ক।
সামাজিক উন্নয়নে বিএনপি দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু, স্বাস্থ্য খাতে টিকাদান কর্মসূচি ও মাতৃ-শিশু সেবা বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল দলটি, যার সুফল জাতি আজ ভোগ করছে। দেশ গঠনে বিএনপির অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট ও বিভাজন দলকে অনেক সময় দুর্বলও করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির গুরুত্ব বোঝার জন্য তিনটি দিক বিশ্লেষণ করা যায় :
১. গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি থাকায় দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চা সম্ভব হয়েছে। একক আধিপত্য গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাকে সক্রিয় রাখে।
২. অর্থনৈতিক নীতি : বিএনপি মূলত বাজারভিত্তিক অর্থনীতি ও বেসরকারি খাতনির্ভর উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গার্মেন্টস খাত বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিয়েছে।
৩. সামাজিক প্রভাব : শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নে বিএনপির নীতিগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যদিও সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে প্রবণতা ছিল উন্নয়নমুখী।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয় : আজকের বিশ্বে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শুধু অতীতের অর্জন নয়, বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই বড় বিষয়। বিএনপির সামনে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। সেগুলো হলো দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা, যুব ও নারীদের রাজনীতিতে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করা, প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়নে নতুন নীতি গ্রহণ করা, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
বিএনপি প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটে, জাতীয় পরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা সামনে আসে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারায় নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। যদিও সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে, তবু বিএনপি বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। অতএব বলা যায়, বিএনপি শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা, গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ও জাতীয় উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক : উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়