ডিমেনশিয়া তথা স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার ঘটনা আমেরিকায় ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ২০৬০ সালের মধ্যে প্রতি বছর বাড়বে ১০ লাখ করে। চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতে সোমবার ১৩ জানুয়ারি ‘ন্যাচার মেডিসিন’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক তথ্য জানা গেছে। আমেরিকায় প্রবীণের সংখ্যা (৫৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষ) বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে ডিমেনশিয়া বিস্তৃত হচ্ছে। এই রোগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের মধ্যে এবং সামনের বছরগুলোতে তা অন্যদের চেয়ে তিণগুণ বেশি হবে বলেও গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, আমেরিকানদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাাওয়ায় আগের তুলনায় এখোন অনেক বেশি মানুষের বয়স ৭০ থেকে ৯০ পেড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ শত বছরে স্পর্শ করছেন এবং তারা কর্মক্ষমও রয়েছেন। গবেষণা জরিপে আরো উদঘাটিত হয়েছে যে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখেই ডিমেনশিয়া রোগের বিস্তার ঘটছে। ৭৫ বছরের অধিক বয়সীরা আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে। এরপর তা চরমে উঠে ৯০ বছর পাড়ি দেয়ার পর। ৯৫ বছর বয়সে কারো কারো স্মৃতিশক্তি একেবারেই লোপ পাচ্ছে।
গবেষণা জরিপ অনুযায়ী ৫৫ বছর পাড়ি দেয়ার পর ৪২% ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি তৈরি হয় এবং তা সারাজীবন বয়ে চলতে হচ্ছে। একইধরনের গবেষণা বেশ কয়েক বছর আগেও চালানো হয়েছিল। তবে সে সময় আমেরিকানদের গড় আয়ু কিছুটা কম এবং চিকিৎসা-ব্যবস্থায় প্রযুক্তি-নির্ভরতা তেমনভাবে না থাকায় স্মৃতিশক্তি ক্রমান্বয়ে লোপ পাবার ব্যাপারটি যথাযথভাবে উদঘাটন করা সহজ ছিল না। এছাড়া, নানাবিধ কারণে আগে শ্বেতাঙ্গরাই প্রাধান্য পেয়েছেন এমন গবেষণায়।
ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের মেডিসিনের অধ্যাপক ড. কেনেথ ল্যাঙ্গা সোমবার বলেন, আগের চেয়ে ডিমেনশিয়ার বিস্তারের ঘটনা কিছুটা কম মনে হলেও সামনের বছরগুলোতে তার লাগাম টেনে ধরার মত পরিস্থিতি তৈরী করা সম্ভব হবে না। কারণ, দিনদিনই প্রবীনের সংখ্যা বেড়ে চলছে। আর এমন অবস্থা তৈরি হবে আমেরিকার মতো গোটাবিশ্বেই।
গবেষণা জরিপে জানা গেছে, বর্তমানে ৬০ লাখের অধিক আমেরিকান ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ ৬৫ বছরের অধিক বয়েসীর ১০% এ রোগে আক্রান্ত এবং এজন্যে চিকিৎসা-সেবায় ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ। আরো জানা গেছে, আমেরিকায় প্রতি বছর এক লাখ মানুষের প্রাণ ঝরছে যারা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন এবং এদের চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে বার্ষিক ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ।
গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের অপ্টিম্যাল এ্যাজিং ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. যোসেফ কোরেশ বলেন, ডিমেনশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ২০৬০ সালে অর্থাৎ ৩৫ বছর পর আমেরিকায় এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ২০ লাখের মত (১২ মিলিয়ন)। যুক্তরাষ্ট্রের ১০ ইউনিভার্সিটির ১০০ জন গবেষক নিয়ে চালানো এই গবেষণা জরিপ টিমের তিনি ছিলেন প্রধান।
মানব সম্পদকে ও অভিজ্ঞতায় সিক্ত মেধাকে দীর্ঘসময় ব্যবহারের স্বার্থে ডিমেনশিয়া রোগ বিস্তারের প্রবণতাকে টেনে ধরতে কিংবা এর গতি আরো স্লথ করার অভিপ্রায়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি করলে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবার প্রবণতা হ্রাস করা সম্ভব। এমন অবস্থার মধ্যদিয়েই ডিমেনশিয়ার বিস্তৃতি ঘটে থাকে বলে গবেষণায় উদঘাটিত হয়েছে। এছাড়া প্রবীণরা যাতে হিয়ারিং এইড ব্যবহারে দ্বিধা না করেন-এমন সচেতনতা বাড়াতে হবে। শ্রবণশক্তি ঠিক থাকলে মানুষের কাজ-কর্মে উৎসাহ অব্যাহত থাকে। মানসিকভাবে সবসময় প্রফুল্ল থাকতেও সক্ষম হয়।
বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স’র অধ্যাপক আলেক্স বেইজার এ প্রসঙ্গে সোমবার বলেন, সমস্যাটিকে খাটো করে দেখার অবকাশ থাকতে পারে না। এটি মারাত্মক একটি সমস্যা। তবে এটি সকল প্রবীনের মধ্যে সমভাবে ছড়িয়ে পড়ে না। কৃষ্ণাঙ্গরা সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে।
ম্যারিল্যান্ড, মিসিসিপি, নর্থ ক্যারলিনা এবং মিনেসোটায় বেশ কয়েক দশকে চিকিৎসা নেয়া প্রবীণ আমেরিকানদের ড্যাটার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। মিসিসিপির ১৫ হাজার রোগীর মধ্যে ২৭% ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণা জরিপে মূলত শ্বেতাঙ্গ এবং আফ্রিকান আমেরিকানদের তথ্যই স্থান পায়। কারণ, অন্য কোন জাতি-গোষ্ঠির রোগী ঐ এলাকায় ততটা পাওয়া যায়নি। গবেষণা টিমের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত আফ্রিকানের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজারের মত। আক্রান্তের ধারা অব্যাহত থাকলে ৪০ বছর পর তা বেড়ে এক লাখ ৮০ হাজার হবে। গবেষণায় আরো উদঘাটিত হয়েছে যে, তুলনামূলকভাবে কম বয়সে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গরা। এবং তাদেরকে এ রোগে ভুগতে হচ্ছে অবশিষ্ট জীবন। এই টিমের প্রধান ড. কোরেশ আরো উল্লেখ করেছেন, আমি পুরোপুরি অনুধাবনে সক্ষম না হলেও আন্দাজ করতে পারছি যে, ভাস্ক্যুলার ঝুঁকিতে থাকারাই অধিক আক্রান্ত হচ্ছেন ডিমেনশনে। হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ কলেস্টোরেলও এই রোগের জন্যে বড় ধরনের হুমকি। স্বল্প শিক্ষিত এবং সামাজিকভাবে অভিজাতশ্রেণীর নয়-এমন লোকেরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন অতীতে।
বিডি প্রতিদিন/এএ