উত্তাল ষাট দশক। রাজপথে স্বাধিকার আন্দোলনে মুখর জনতা। মানুষের বুকে দ্রোহের আগুন জ্বলছে। মিছিল, স্লোগান ও মুক্তিযুদ্ধের পথে যাত্রা করেছে মুক্তিকামী জনতা। সেই দ্রোহকে কবিতার উপকরণ বানিয়েছেন হেলাল হাফিজ। বলেছেন মিছিলের কথা, স্লোগানের কথা। স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন দেশে সুখী জীবন কাটানোর। লিখেছেন, ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।’ ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি লিখলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। সেসময় মিছিলের স্লোগানে জড়িয়ে যায় তাঁর লেখা পঙ্তিমালা- ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ হয়ে ভেসে উঠেছে তার এই বিদ্রোহের বাণী। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ছাত্রজীবনেই কবি হিসেবে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করেন তিনি। ক্যাম্পাসের আড্ডায় মুখে মুখে ঘুরতে থাকে তাঁর লেখা কষ্টের পঙ্ক্তি।
কবির দ্রোহের সঙ্গী হয়েছে প্রেম। নিঃসঙ্গতার যাতনা, পার্থিব অপ্রাপ্তি তাঁর কবিতায় আশ্রয় নিয়েছে বারবার। কষ্টের ফেরিঅলা হয়ে বলেছেন, ‘একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট।’ প্রেমমুগ্ধ ছিলেন তিনি। করেছেন অমীমাংসিত সন্ধি- ‘তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো/ পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।’ শুধু প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ নয়, জীবনের কঠিন কথাও বলেছেন, ‘একটা কিছু করুন/ এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে/ দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন/ একটা কিছু করুন।’ মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের কথা বলেছেন নিঃসংকোচে- ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের এ রাতে বিস্ময়করভাবে প্রাণে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাঁকে বৈরাগ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সেসময় তিনি থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে। হেলাল হাফিজ নিজেই বলেছিলেন, সেই রাতে যদি ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহর সাথে দেখা করতে না যেতেন, তাহলে হয়তো শহীদ হওয়া নিশ্চিত ছিল। পরে ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর কবি নিজের হলে গিয়ে দেখেন, চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা হয় তার। তাকে জীবিত দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেন নির্মলেন্দু গুণ।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তাকে রাতারাতি কবিখ্যাতি এনে দেয়। এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার শেষে দেওয়া তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে। কাব্যগ্রন্থটির ৩০টিরও বেশি সংস্করণ হয়েছে। যা এদেশে বিরল। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি হেলাল হাফিজ। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে হেলাল হাফিজের জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তিনিও কবিতা লিখতেন। মা কোকিলা বেগম ছিলেন গৃহিণী। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান কবি। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সে সময় দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
কবি হেলাল হাফিজের বৈরাগ্য, প্রেম, অভিমানে অন্তরালের খবর কজন জানত? ১৯৭৩ সালে বাবাকে হারান। মাতৃহারা কবি বাবাকেই জীবনের আশ্রয়স্থল হিসেবে পেয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর একা হয়ে যান তিনি। এর মাসখানেক পর প্রেমিকা হেলেনের সঙ্গেও কবির বিচ্ছেদ হয়। হেলেন তাঁকে ডেকে বলেন, “আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।” সেদিনের কথা স্মরণ করে হেলাল হাফিজ এক লেখায় বলেছিলেন, “ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। সেখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে চলে এলাম।” বুকের ভেতর কষ্টের পাখি উড়ছিল তার। প্রস্থান কবিতায় লিখলেন, ‘আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি/ নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে/ পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?/ এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে, এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!’
কবিতার অভিনয় উজ্জ্বল বিচরণ ছিল তাঁর। এজন্য বহু স্বীকৃতি, সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৩ সালে হেলাল হাফিজকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়াও যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
নিভৃত জীবনের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের আকাশচুম্বী খ্যাতির চেয়ে হয়তো ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখবোধ তাকে নিয়ে যায় নিজের নিভৃত জগতে। শেষ বয়সে নানাবিধ রোগে কাবু হয়ে পড়েন কবি। একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জীবনের এই শেষ বেলায় মন তো চায়, কেউ একজন পাশে থাকুক। এটা যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক।’ জানতে চাওয়া হয়, জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি কাজ করে মনে? হাহাকার বা না পাওয়ার বেদনা? বললেন, ‘কবিতায় একবার বলেছিলাম- বেঁচে আছি একা নিদারুণ সুখে।’ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র একটা কবিতা শুরু হয়েছে এভাবে- কোনো প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়/কোনো প্রাপ্তি দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি/ সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে/ গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা।
মানুষ যতই পায়, আরও থাকে চাহিদা। তৃপ্তি মেটে না। আবার কিছু কিছু মানুষ অনেক কিছুই না পেয়েও তৃপ্ত। আমি মনে হয় দুইটার মধ্যেই আছি। আমার মতো সৌভাগ্যবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর কেউ নেই। এতো অল্প লিখে এতো ভালোবাসা কেউ পায়নি। আমার দুই বই মিলিয়ে ১০০ কবিতাও হবে না। তাও মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, প্রাপ্তি আমায় মুগ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যে তাকিয়ে দেখ, দ্বিতীয় কেউ নেই।’
জীবনের শেষ দিনগুলোতে একাকী থাকতেন ঢাকার শাহবাগে সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে। এক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন, পরিবারের সবাই সব সময় তার খোঁজ রাখে, বোনরা একটু বেশি রাখে। তবে নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতাই তার ভালো লাগে। হোটেলবাসের একাকিত্ব তিনি ‘উপভোগ’ করেন। উদযাপন করেন। গত ১৩ ডিসেম্বর সে হোস্টেলেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। অকৃতদার কবির বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। চলে যাওয়ার আগে কবিতার পৃথিবীতে তিনি রেখে গেছেন নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, দুঃসময়ে আমার যৌবন, অস্ত্র সমর্পণ, বেদনা বোনের মতো, ইচ্ছে ছিল, নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি, দুঃখের আরেক নাম, প্রত্যাবর্তন, অশ্লীল সভ্যতা, কবিতার কসম খেলাম, উপসংহার, সম্প্রদান, একটি পতাকা পেলে, কবি ও কবিতা, ফেরিঅলা, অমীমাংসিতর মতো অসামান্য সব কবিতা।
বাংলা কবিতার পাঠক দীর্ঘদিন তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আর জাতির যে কোনো সংকটকালে বারবার লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হবে তার উদ্দীপ্তকরণের অমর পঙ্ক্তি ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...।