শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদে আসাদের তোলা ছবি

জামশেদ আলম রনি

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদে  আসাদের তোলা ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশি আলোকচিত্রী কে এম আসাদের তোলা একটি ছবি। বাংলাদেশি কোনো আলোকচিত্রীর ছবি এই প্রথম স্থান পেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে ছবিটি তোলা হয়েছে। ছবিতে দেখা যায় সেখানে আশ্রয় নেওয়া একজন রোহিঙ্গা মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে জল ডিঙ্গিয়ে এগোচ্ছেন। শিশুটির চোখেমুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া। ম্যাগাজিনটির এবারের বিষয় অভিবাসন সমস্যা। সম্প্রতি এ সুখবর জানিয়ে কে এম আসাদ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা দিন। আমার তোলা একটি ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদ হওয়ায় আমি ধন্য। ২০০৫ সালে ছবির মাধ্যমে গল্প বলতে শুরু করেছিলাম। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, একদিন আমার তোলা ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নেবে। এটি পূরণ হওয়ায় আমি অনেক আনন্দিত। আমার সব পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছি।’ কে এম আসাদ জানান, ‘এ ছবিটি ২০১৭ সালে তুলেছিলাম। এর সুবাদে ওই বছর ইউনিসেফ ফটো অব দ্য ইয়ারে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। দুই মাস আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন সম্পাদক কল দিয়ে জানান আমার তোলা ছবি নিয়ে প্রচ্ছদ করতে চান। তারা একটি ওয়েবসাইটে এটি দেখেছেন। তবে প্রচ্ছদের জন্য তারা তিনটি ছবি রেখেছিলেন তালিকায়। সমস্যা হয়েছিল রোহিঙ্গা মা ও তার সন্তানের অনুমতি লাগবে! এটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের নিয়ম। কিন্তু তাদের তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেই সময় সাগরপাড়ি দিয়ে অনেকের মতো ওই নারী তার সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসেন কক্সবাজারে। আর তার মুখও আমি তেমন খেয়াল করিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে জানালাম, রণাঙ্গনে যদি কোনো আলোকচিত্রী ছবি তোলেন তাহলে কি তার পক্ষে অনুমতি নেওয়া সম্ভব? আমার যুক্তি তাদের মনে ধরে। তাই আর সমস্যা হয়নি।’ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অন্যতম পরিচালক আমেরিকান আলোকচিত্রী সারাহ লিনের খুব ভালো লেগেছে কে এম আসাদের ছবিটি। তিনি এটাই প্রচ্ছদ করার পক্ষে ছিলেন। তাই তার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার কথাও ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান কে এম আসাদ। সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সব সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। বন্ধু আর ফলোয়ারদের ধন্যবাদ জানান এ আলোকচিত্রী। আগামী ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্ণ হবে। এ উপলক্ষে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এবারের সংখ্যা রোহিঙ্গা ও অভিবাসন নিয়ে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে ছবির গল্পে বলা হয়েছে, কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন ৬০টি শিশুর জন্ম হচ্ছে। এতে তুর্জয় চৌধুরীর তোলা বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশুর স্থিরচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন অলাভজনক সংগঠন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ১৯৮৮ সাল থেকে ম্যাগাজিন প্রকাশ করে আসছে। বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ও বিশ্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয় এতে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তাদের স্বীকৃত (ভেরিফায়েড) ফেসবুক পেজে আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রকাশ করেছে ১৬ জুলাই। ‘ওয়ার্ল্ড অন দ্য মুভ’ শিরোনামে সেই প্রচ্ছদের ছবির সঙ্গে লিখেছে, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ যে বিশালসংখ্যক মানুষ বলপূর্বক বা বাধ্যতামূলক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তাই এ (আগস্ট) মাসে সাময়িকীটি দৃষ্টিপাত করেছে সেই অভিবাসন এবং তার পেছনের কারণগুলোর ওপর। বাস্তুচ্যুত হওয়ার নেপথ্যে যেমন রয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, তেমনি আছে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ বিষয়। বাধ্যতামূলক অভিবাসনকে ভিন্ন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সাময়িকীর আগস্ট সংস্করণে। ছবিটি তোলার প্রেক্ষাপট : ২০১৭ সালে মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বানের স্রোতের মতো বাংলাদেশে আসে। সে সময় অনেক আলোকচিত্রীর মতো আসাদও ছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফে। কয়েক দিন টেকনাফে কাজ করার পর আসাদ খবর পান, সাগর পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু ঠিক দ্বীপের কোন পথে আসে, কিংবা আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। এ সময় অন্য ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে আসাদও যান শাহপরীর দ্বীপে। আসাদ গণমাধ্যমক  বলেন, ‘দিনভর অপেক্ষার পর ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সবাই। ঠিক তখনই দৃষ্টির শেষ সীমায় একটা বিন্দুর মতো কিছু দেখতে পাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা নিশ্চিত হই যে সেটা একটা নৌযান।’ সেই নৌযান তীরে এসে ভিড়ল রোহিঙ্গাদের নিয়ে। আলোকচিত্রীরা ছবি তুলতে শুরু করলেন। আসাদও তুলছেন। ঠিক সে সময়েই তার মনে হলো, ফ্রেমের বাইরে কিছু একটা চলে গেল। তিনি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখেন এক রোহিঙ্গা নারীকে, যিনি সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড় থেকে শিশু সন্তানকে বাঁচাতে তীরের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। তখনই সেই শিশুর মুখ দেখলেন আসাদ। শিশুর মুখে যন্ত্রণার ছাপ। আসাদ বলে যান ছবি তোলার মুহূর্তের কথা, ‘শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া সম্ভব কী হয়েছিল ওপারে। সে সময় আমার মনে হয়েছিল, অন্য কিছু নয়, সেই মুখাবয়ব, সেই অভিব্যক্তি আমাকে ধারণ করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর