এক সময় জিমন্যাস্টিকসে একক দাপট ছিল আক্তারুজ্জামান শাহিনের। একের পর এক ইভেন্টে সোনা জয় করেছেন। বছরের পর বছর ধরে আধিপত্য দেখিয়েছেন। সেই শাহিনকে এখন দেখলে চমকে উঠতে হয়। বিরল পারকিনসন রোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। সার্বক্ষণিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয় তার। পরিবারের সদস্যরা শিশুর মতোই আগলে রেখেছেন শাহিনকে।
টানা ১৬ বছর পামেল হর্সে সোনাজয়ী জিমন্যাস্ট কেন এমন হয়ে গেলেন? শারীরিক সুস্থতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন পরিবারের অন্যতম একজন। শাহিনের শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার কারণে। এক সময় দাপটের সঙ্গে জিমন্যাস্টিকসের বারে খেলেছেন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার কমিটিতেই ছোট ভাই কামরুজ্জামান হিরু ছিলেন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। দুই ভাই একত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন বডি বিল্ডিং ফেডারেশনে কার্যনির্বাহী কমিটিতেও। এখানেও শাহিন ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক এবং হিরু ছিলেন সদস্য। দুই ভাই ফেডারেশনে দায়িত্ব পালন করছিলেন ভালোভাবেই। তবে ২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ফেডারেশন থেকে দূরে সরে যেতে হয় শাহিনকে। পাশাপাশি তার ভাই হিরুকেও। শাহিন ক্রীড়াঙ্গন থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর চরম হতাশায় পড়েন। ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে। বর্তমানে কঙ্কালসার শাহিনকে দেখলে গত শতকের ৮০ ও ৯০ দশকের সেই সোনার ছেলেকে কেবল দূরের অতীত বলেই মনে হবে! অতীতের ছবিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে চেনার কোনো উপায় নেই। আক্তারুজ্জামান শাহিনের পদক জয়ের যাত্রা ১৯৮৬ সালে। সে বছর জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১টি সোনার পদক ও ২টি রুপার পদক জয় করেন তিনি। নজর কেড়ে নেন জিম্যাস্টিকসের সঙ্গে জড়িত সবার। পরপর থেকে টানা পদক জয় করতেই থাকেন শাহিন। টানা ১৬ বছর জাতীয় জিমন্যাস্টিকসের পমেল হর্স ইভেন্টে সোনা জয়ের গৌরব অর্জন করে এক অনন্য রেকর্ড গড়েন তিনি। সব মিলে ক্যারিয়ারে ২৩টি সোনা, ৪টি রুপা এবং ৮টি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেছেন শাহিন। বাংলাদেশে খেলার জগতে গত দেড় দশকে অনেকেই জাতীয় নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তবে কেউ খবর নেয়নি শাহিনের। তার প্রিয় ফেডারেশন থেকে কোনো সহযোগিতা তো বহু দূরের ব্যাপার, খোঁজও রাখা হয়নি। বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে বড় অবদান রাখার পরও তার কোনো স্বীকৃতি নেই। বরং বঞ্চনার শিকার হয়ে অসহনীয় এক জীবন কাটাচ্ছেন। শাহিনের ভাই ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান হিরু বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন আমার ভাই। অথচ তিনি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। কেউ কখনো তার খবরও নিতে আসেনি।’
কেবল শাহিন কিংবা হিরুই নন, ফকিরেরপুলের জামান পরিবার বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে অনেক কিছুই দিয়েছে। একই পরিবারের পাঁচ ভাই-বোন জিমন্যাস্টিকসে নিজেদের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। শাহিনের পাশাপাশি হিরুও পদক জয় করেছেন জাতীয় প্রতিযোগিতায়। এ ছাড়া নুরজাহান বেগম হীরা, তাসলিমা খাতুন কেয়া, শাহাদাতুজ্জমাান শিমুর কৃতিত্ব আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকসে। শাহিনের মেয়ে সামিরা জান্নাত জামান তায়কোয়ান্দোর এক উজ্জল তারকা। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সোনার পদকসহ বেশ কয়েকটি পদক জয় করেছেন তিনি। বাপ-চাচাদের পথ ধরে ছুটে চলেছেন সামিরা। একই পরিবারের এমন কৃতিত্ব বাংলাদেশে এক বিরল ঘটনা। তবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়েছে তাদের গৌরব গাথা।