বিশ্বকাপ শুরুর দুই সপ্তাহ আগে কলম্বোর সেন্ট্রাল ব্যাংকে বোমা হামলা করে তামিল টাইগার্সরা। উদ্দেশ্য ছিল ভীতি সৃষ্টি করে বিশ্বকাপ আসর বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী জানান দেওয়া। কিন্তু লঙ্কান সরকার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কঠোর নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আইসিসির কাছে। কিন্তু আপত্তি করে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। তবে সময় খুব কম থাকায় ভেন্যু পরিবর্তন করাও সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া সন্ত্রাসী হামলা হলেও লঙ্কানদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল আইসিসি। তাই অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরোধিতা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কায় খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে আইসিসি।
ক্রিকেটারদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায়নি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। তাই কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ম্যাচ দুটি খেলতে অস্বীকৃতি জানায় দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এক্ষেত্রে বোমা হামলা যেন 'শাপেবর' হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার। দুই ক্রিকেট পরাশক্তির বিরুদ্ধে ম্যাচ দুটি 'ওয়াকওভার' পেয়ে যায় তারা। কোয়ার্টার ফাইনালের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায় শ্রীলঙ্কার। কিন্তু অর্জুনা রানাতুঙ্গার দল শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে রীতিমতো চমক সৃষ্টি করে। গ্রুপের অন্য দুই সদস্য জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়াকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে 'গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন' হয়ে শীর্ষ ৮ নিশ্চিত করে।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে তো পাত্তাই দিল না শ্রীলঙ্কা। আর সেমিফাইনালে যেন ম্যাজিক দেখাল রানাতুঙ্গার দলটি। ভারতকে বিধ্বস্ত করে পৌঁছে গেল ফাইনালে। ওই ম্যাচে এক শচীন টেন্ডুলকার ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান লঙ্কান বোলারদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। মাত্র ১২ রানেই তিন উইকেট নেন সনাৎ জয়সুরিয়া। ফাইনালেও প্রতিপক্ষকে পাত্তা দেয়নি লঙ্কানরা। অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করে।
ভাগ্যই বটে শ্রীলঙ্কার। বিশ্বকাপ শুরুর আগে যে দলটিকে কেউ ফেবারিটের তালিকাতেই রাখেনি, অথচ সেই দলটিই কিনা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন। লঙ্কানরা ক্রিকেটবিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, বিশ্বমানের তারকা না থাকলেও দলীয় সমন্বয়ে বিশ্বকাপ জয় করা যায়।
৯৬-র বিশ্বকাপে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সহ আয়োজন করেছিল শ্রীলঙ্কা। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে ছিল দ্বীপ রাষ্ট্রটি। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে যাওয়ায় আসরটা এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তানের জন্য হয় থাকে 'বিষাদময়'। পাকিস্তানের কপাল পুড়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হওয়ায়। কেননা বিশ্বকাপে কখনোই ভারতকে হারাতে পারেনি তারা। আর ভারতের বিদায়টা ছিল অকল্পনীয়। সেরা সেরা তারকাদের নিয়েও ঘরের মাঠে দলকে শিরোপা এনে দিতে পারলেন না মোহাম্মদ আজহার উদ্দীন। তবে সেমি থেকে বিদায় নিলেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারের পুরস্কার পেয়েছেন ভারতের দুই তারকা- শচীন টেন্ডুলকার ও অনীল কুম্বলে। ব্যাটিং জিনিয়াস দুইটি সেঞ্চুরিসহ ৫২৩ রান করেন। বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড ছিল সেটি। আর ঘূর্ণি মায়ায় দিশেহারা করে ১৫টি উইকেট নিয়েছিলেন কুম্বলে। তবে 'ম্যান অব দ্য সিরিজ' হয়েছিলেন লঙ্কান তারকা সনাৎ জয়সুরিয়া। ঝড়োগতির ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দুর্দান্ত স্পিন বোলিং করতেন লঙ্কান তরুণ তুর্কি।
কারো এক ক্যারিশমা না থাকলেও ৯৬-র বিশ্বকাপে অসাধারণ ক্রিকেটারদের দলে পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। সনাৎ জয়সুরিয়া ছাড়াও অরবিন্দ ডি সিলভা, হাসান তিলকারত্নে, চামিন্দা ভাস, মুত্তিয়া মুরালিধরন, রোশন মাহানামা, রমেশ কোলোভিতরানা -দিক নির্দেশক হিসেবে ছিলেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। বিশ্বকাপের আগে তাদের নিয়ে কোনো আলোচনা না হলেও শিরোপা জয়ের পর এক একজন হয়ে যান 'মহানায়ক'।