এক. ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ উঠলেই বাংলাদেশিদের স্মৃতিপটে ভেসে একটা সুখ ছবি- ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনের কাউন্টি গ্রাউন্ডের চারপাশ দৌঁড়ে ভিক্টরি ল্যাপ দিচ্ছেন আকরাম, বুলবুল, দূর্জয়, সুজনরা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়টা নিশ্চিত হওয়ার পর আনন্দ উৎসব হয়েছে গোটা দেশেই। খেলার মাঠে কোনো এক জয় যে পুরো জাতিকে এভাবে উল্লসিত করবে তা কারো জানা ছিল না। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে পুরো জাতি উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় বলে কথা! আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়ে ৬২ রানের ওই বিজয়কে অনেক ৭১-র পর দ্বিতীয় জয় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরাজয়ের পর সেই পাকিস্তানই ৯৯-র বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছিল। তবে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই বাজিমাৎ করেছিল টাইগাররা।
দুই. বার্মিংহামের এজবাস্টনের সেই মহাকাব্যিক সেমিফাইনালের কথা ভোলার নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়া- হাইভোল্টেজ ম্যাচ। শুরু থেকেই টান টান উত্তেজনা। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ও মাইকেল বেভানের হাফ সেঞ্চুরির পরও প্রোটিয়া বোলার অ্যালান ডোনাল্ট ও শন পোলকের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ২১৩ রানের বেশি করতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। পলট ৩৬ রানে ৫ উইকেট এবং ডোনাল্ট ২৭ রানে ৪ উইকেট নেন। প্রথম ইনিংসের পর মনে হচ্ছিল ম্যাচে সহজেই জিতে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাজিক দেখালেন অসি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন। প্রথম থেকে টানা চার উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাটফুটে পাঠিয়ে দিলেন ওয়ার্ন। নিয়ন্ত্রিত বোলিং করলেন গ্লেন ম্যাকগ্রাথ ও ডেমিয়ে ফ্লেমিং। ম্যাচ ঘুরে গেল। যদিও ৬১ রানে ৪ উইকেট পতনের পর ম্যাচটা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন জ্যাক ক্যালিস ও জন্টি রোডস। শেষ দিকে ক্লুজনার ঝড়ে প্রায় জিতেই গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্কোর সমান হওয়ার পর বিজয় সূচক রানটি আর নিতে পারেননি ক্লুজনার। অপর প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যান ডোনাল্ট রান হওয়ায় ম্যাচটা টাই হয়ে যায়। আর সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে বেশি হওয়ায় ফাইনালে উঠে যায়। তারপর ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৮ উইকেটের সহজ জয়ে চ্যাম্পিয়ন।
তিন. ৯৯-র বিশ্বকাপকে মজা করে অনেকে বলে থাকেন দুই জমজ ভাইয়ের বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ার দুই তারকা ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ ও স্টিভ ওয়াহ। একজন ওপেনার আরেক জন অধিনায়ক। দুই ভাই-ই সেবার অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। ৩৯৮ রান করে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহ স্টিভ ওয়াহ, আর ৩৭৫ রান রান করে মার্ক ওয়াহ চতুর্থ সর্বোচ্চ। তবে সেমিতে উঠতে ব্যর্থ হলেও ওই বিশ্বকাপে সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানের দুইজনই ভারতীয়। ৪৬১ রান করে রাহুল দ্রাবিড় ছিলেন শীর্ষে, আর তৃতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল সৌরভ গাঙ্গুলীর (৩৭৯ রান)।
চার. প্রোটিয়া তারকা ল্যান্স ক্লুজনারের জন্য আসরটি ছিল যেমন সাফল্যের তেমনি হতাশারও। ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সেবার বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিল তিনি। কিন্তু মহাকাব্যিক সেই সেমিফাইনাল ম্যাচে উইকেটে অপরাজিত থাকার পরও দলকে জয় এনে দিতে না পারার যন্ত্রণা ক্লুজনারকে এখনো কষ্ট দেয়। তবে আসরটি যে অসি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের কিংবদন্তির কাতারে নিয়ে গিয়েছিল তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বল হাতে সেবার ২০ উইকেট নিয়েছিলেন। অবশ্য ২০ উইকেট নিয়ে ওয়ার্নের সঙ্গে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার রেকর্ডে নাম থাকবে কিউই বোলার জিওফ অ্যালোটেরও। সে আসরে অসারধণ বোলিং করেছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রাও। ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন অসি পেসার। সব মিলে সেবার অস্ট্রেলিয়া পুরো দলই অসাধারণ খেলেছিল। এক যুগ পর আবারো হারানো মুকুট ফিরে পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
এক নজরে
চ্যাম্পিয়ন :অস্ট্রেলিয়া।
রানার্সআপ : পাকিস্তান।
আয়োজক : ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও ওয়েলস।
সিরিজ সেরা : ল্যান্স ক্লুজনার (দক্ষিণ আফ্রিকা)।
সর্বোচ্চ রান : রাহুল দ্রাবিড়-৪৬১।
সর্বাধিক উইকেট : শেন ওয়ার্ন-২০, জিএফ অ্যালট-২০