'ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্স যত বেশি দরকার, তার চেয়ে ঢের প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তা। আমরা খেলেছি ভালো, কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না।' -১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর মন্তব্যটি করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের তখনকার অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। ক্যান্সারে আক্রান্ত শয্যাশায়ী ক্রো নিশ্চয়ই ম্যাককালামদের দাপুটে জয়ের পর তার কথা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন! ম্যাককালামরা দেখিয়ে দিয়েছেন, ভালো পারফরম্যান্স দিয়ে ভাগ্য নিজ হাতে গড়েও নেওয়া যায়!
তবে মার্টিন ক্রো তার কথা প্রত্যাহার করুক বা না করুক-দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে যাওয়ায় তিনিই যে সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না! তিনি যা পারেন নাই, তাই করে দেখিয়েছেন ম্যাককালাম। ২৩ বছর আগে যে অকল্যান্ডের ইডেন পার্ক থেকে কাঁদতে কাঁদতে কিউই ভক্তরা বের হয়েছিলেন, এবার সেই স্টেডিয়াম থেকে তারা বের হলেন স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে! ১৯৯২ বিশ্বকাপেও স্বাগতিক ছিল নিউজিল্যান্ড। মার্টিন ক্রোর নেতৃত্বে সেই দলটা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। গ্রুপ পর্বে প্রতিপক্ষ প্রতিটি দলকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে উঠেছিল সেমিফাইনালে, যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে ক্রো-র ৮৩ বলে ৯১ রানের সুবাদে নিউজিল্যান্ডের স্কোর হয় ২৬২ রান। কিউইদের আগুন ঝরা বোলিংয়ে ১৪০ রানে চার উইকেট হারায় ইমরান খানের পাকিস্তান।
ব্লাক ক্যাপস সমর্থকরা যখন ফাইনালে ওঠার উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই ইনজামামের ৩৭ বলে ৬০ রানের ঝড়ো এক ইনিংস সব পণ্ড করে দেয়। এরপর আর ফাইনালের স্বপ্ন পূরণ হয়নি নিউজিল্যান্ডের। বিশ্বকাপে একে একে ছয় ছয়বার সেমিফাইনাল থেকে ফিরতে হয়েছে তাদের। বিশ্বকাপের ফাইনাল যেন কিউই ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের কাছে রূপকথার গল্প হয়েছিল। যে গল্প শুনতে অনেক ভালো লাগে, রোমাঞ্চ কাজ করে মনে, কল্পনায় যে গল্পে নায়ক হওয়ায় কিন্তু বাস্তবে সেমিফাইনালের গণ্ডি আর পার 'হওয়া' হয় না।
কিন্তু এবার শুরু থেকেই কেমন যেন অনেক বেশি আত্দবিশ্বাসী কিউইরা। তবে ২১ মার্চ কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হয়তো কিছু 'নার্ভাসনেস' কাজ করছিল ম্যাককালামদের মনে! প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্যারিবীয়রা যে এবার 'ভয়ঙ্কর' দল, তা কিন্তু নয়! কিউইদের ভয় ছিল ইতিহাসকে, ভয় ছিল '২১ মার্চ' তারিখটাকে। কেননা ২৩ বছর আগে পাকিস্তানের এই দিনেই 'জেতা' ম্যাচে হেরেছিল তারা। কিন্তু এ ম্যাচে ক্যারিবীয়দের কোনো সুযোগ দেয়নি নিউজিল্যান্ড। মার্টিন গাপটিল দুরন্ত এক ডাবল সেঞ্চুরি করে প্রথম ইনিংসেই যেন ম্যাচ জিতে গিয়েছিল! সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের টার্গেট যখন ৪৩ ওভারে ২৯৮ রান, তখন অনেকেই ২৩ বছর আগের দুঃস্মৃতি হাতরাচ্ছিলেন! কেননা ওই ম্যাচটি যে অকল্যান্ডের যে ইডেন পার্কে হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচটিও যে একই ভেন্যুতে! কিন্তু ম্যাককালাম প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে প্রথম পাঁচ ওভারে ৭১ রান তুলে ভক্তদের আশ্বস্ত করলেন! তারপরও নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু শেষ ওভারে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেন ইলিয়ট। বলতে গেলে অসম্ভব এক ম্যাচে জিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে নিউজিল্যান্ড।
এখন ক্রিকেট বিশ্বে চলছে কিউই বন্দনা। এবারের বিশ্বকাপে তারা অপরাজিত থেকে উঠেছে ফাইনালে। এদিকে অন্য সেমিতে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে ফাইনালের টিকিট পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হচ্ছে দুই স্বাগতিক। বিশ্বকাপে এর আগের ১০ আসরে এমন দৃশ্য আর দেখা যায়নি।
নিউজিল্যান্ডের জন্য স্বস্তিদায়ক ঘটনা হচ্ছে, গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে একবার হারিয়েছে। শঙ্কা এখানেই যে, খেলা হবে মেলবোর্নে। তবে খেলা কোথায় হচ্ছে তা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন কিউই ভক্তরা। তাদের বিশ্বাস, এই বিশ্বকাপে ম্যাককালামদের হারানোর ক্ষমতা কারও নেই। কিউইদের কাছে অধিনায়ক ম্যাককালাম যেন রূপকথার রাজকুমার। যিনি ব্যাটিংয়ে জাদু (ম্যাককামালের স্টাইকরেট ১৯২, এই আসরে সর্বোচ্চ) দেখিয়ে চড়াই উতরাই পেড়িয়ে নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের পথে। আর মাত্র একটা ধাপ পেরুলেই কিউইরা পৌঁছে যাবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। -সেটা নিশ্চয়ই বিশ্বকাপের শিরোপা!