মিনহাজ সাহেবের বাংলোবাড়ির কেয়ারটেকার নুরু মোল্লার একমাত্র মেয়ে রেশমার বয়স ১২ বছর। কুসুমপুর প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্কুল। স্কুল শেষ করে বাড়ি এসে গোসল সারে রেশমা। তারপর দু-আড়াই ঘণ্টার একটা ঘুম দেয়। ৩টার দিকে উঠে ভাত খায়। খাওয়া-দাওয়ার পর তার হাতে আর কোনো কাজ থাকে না। বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়ায়। পেছন দিককার বাগানে যায়, সামনের দিককার ফুল পাতাবাহারের ঝোপের দিকে ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো বাংলোর বারান্দায় বসে একা একা পুতুল খেলে।
রেশমার মা-বাবা দুজনেই পরিশ্রমী মানুষ। আলস্য বলতে কিচ্ছু নেই শরীরে। এক মিনিটের জন্য বসে থাকছে না। কোনো না কোনো কাজ করছেই। বাবা করছে বাগান গাছপালা ফল-সবজির তদারক, মা করছে বাংলোর বিভিন্ন রুমের সাফ সাফাইয়ের কাজ। আসবাবপত্র ঝাড়ছে, মেঝে মুছছে, গ্রিল মুছছে। কাজের অন্ত নেই। এক কাজই দু-এক দিন পর পর করছে।
বাবার চেয়ে মা'র পরিশ্রম অবশ্য বেশি। তিনজন মানুষের রান্নাবান্নার কাজও তাকে করতে হয়। ওসব করেও বাংলোবাড়ির নানারকম কাজ সে করছে।
মা-বাবার স্বভাব পায়নি রেশমা। সে একটু অলস টাইপের। ৩টার পর কোনো কোনো দিন বাড়ি থেকে বেরোয়। মোড়লদের মেহগনি বাগানের দিকে যায়, দিপুদের বাড়ির দিকে যায়। দুপুর শেষের নির্জনতা, গাছপালা, পাখির ডাক আর হাওয়ার শব্দ তার ভালো লাগে। যেদিন এসবও ভালো লাগে না সেদিন যায় আড়তদার সোনা মিয়ার বাড়িতে। সোনা মিয়ার ছোট মেয়ে রুবিনার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব রেশমার। দুজন এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। রুবিনাদের বাড়িতে গিয়ে দুজনে বসে বসে গল্প করে, একসঙ্গে বেড়াতে বেরোয়।
আজ রেশমা মাত্র খাওয়া শেষ করেছে, রুবিনা এলো। রেশমা, রেশমা।
রেশমা হাসিমুখে ঘর থেকে বেরোল। কী রে?
চল।
কোথায়?
ঘুরে আসি।
কোথায় ঘুরবি?
যেখানে আমরা ঘুরি। দিপু ভাইয়াদের বাড়ির ওদিকটায়।
রেশমার মা বলল, বাইরে ঘুরতে যাওয়ার দরকার কী? বাড়িতে বসেই গল্প কর। দরকার হলে বাগানের দিকে যা।
রুবিনা বলল, না খালা, বাড়িতে ভালো লাগছে না।
নুরু মোল্লা বাগানের দিকে যাচ্ছিল। রুবিনার কথা শুনে বলল, আচ্ছা যা। বাড়িতে যখন ভালো লাগছে না, বাইরেই ঘুর গিয়ে।
রেশমা রুবিনা তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে, রুবিনা বলল, আচার খেতে ইচ্ছা করছে।
রেশমা অবাক হলো। কী খেতে ইচ্ছা করছে? আচার?
হ্যাঁ।
কিসের আচার?
তেঁতুল, বরই, আমের আচার।
পাবি কোথায়?
পাব এক জায়গায়। চল।
কোথায় পাবি বল আমাকে।
রুবিনা হাসল। চল আমার সঙ্গে। গেলেই বুঝবি।
রুবিনার একটু রহস্য করার অভ্যাস আছে। রেশমা জানে এখন হাজার চেষ্টা করলেও রহস্য ফাঁস করবে না সে। সুতরাং সে আর কথা বলল না, পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে দিপুদের বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াল।
রুবিনা বলল, এখন বুঝেছিস আচার কোথায় পাব?
রেশমা হাসল। বুঝেছি, বিবিখালার কাছে।
হ্যাঁ। বিবিখালা বোতল বোতল আচার বানিয়ে রাখে। তেঁতুলের আচার, জলপাই বরই চালতার আচার। আমের আচার তো আছেই।
তা আমি জানি। কিন্তু চাইলেই কি খালা আমাদেরকে আচার দেবে?
দেবে। আমরা কি কোনো দিন চেয়েছি নাকি! একবার চেয়ে দেখি না!
রেশমা কথা বলল না।
রুবিনা আলতো করে তাকে একটা খোঁচা দিল। কী রে চুপ করে আছিস কেন?
এমনি।
না এমনি না। আমি জানি কেন চুপ করে আছিস?
কেন আছি বল তো?
তোরও আচার খেতে ইচ্ছা করছে।
রেশমা হাসল। হ্যাঁ। বরইর আচার হেবি্ব মজার জিনিস।
ওই জিনিসই তোকে এখন খাওয়াব। দেখিস ঠিকই খালাকে পটিয়ে ফেলব।
রুবিনা কলিংবেলে হাত দিতে যাবে, রেশমা বলল, কলিংবেল বাজাতে হবে না। গেট খোলা।
রুবিনা অবাক হলো। তাই তো! কিন্তু গেট খোলা কেন? এ সময় দিপু ভাইয়াদের বাড়ির গেট খোলা থাকার কথা না। সবাই স্কুলে থাকে। বাড়িতে শুধু বিবিখালা। গেট খোলা রেখে খালা কোথাও যায়ও না।
রেশমা বলল, স্যার ম্যাডাম কেউ চলে এলো নাকি!
কী জানি।
দিপু ভাইয়া আসতে পারে। সোনার বাংলা স্কুলে আজ ক্লাস হয়নি। মিলাদ ছিল।
সে থাকলে অসুবিধা নেই।
তার সামনেই আচারের কথা বলবি খালাকে?
বললে অসুবিধা কী?
রুবিনার হাত ধরল রেশমা। না থাক।
কেন?
আমার লজ্জা করছে।
কিসের লজ্জা। আমরা কি চুরি করতে আসছি নাকি?
আজ থাক। আরেক দিন আসব।
আরে না, কিচ্ছু হবে না। আয় আমার সঙ্গে।
রেশমার হাত ধরে অনেকটা জোর করেই তাকে নিয়ে দিপুদের বাড়িতে ঢুকল রুবিনা। উঠোনের দিকে এসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। কাউকে কোথাও দেখতে পেল না। বিবিখালার বারান্দায় রোদে পড়ে আছে আচারের বোতল বয়াম।
সেদিকে তাকিয়ে রেশমা বলল, বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে।
রুবিনা রেশমার দিকে তাকাল। আমারও তাই মনে হচ্ছে।
খালা মনে হয় কোথাও গেছে।
হতে পারে।
তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল।
আচারের বোতল বয়ামের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে রুবিনা তার আগেই বিবির ঘর থেকে কেমন একটা শব্দ এলো। যেন মেঝেতে শরীর ঘষছে কেউ।
ওরা দুজন সেই ঘরের দিকে তাকাল। ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ভেতরটা অন্ধকার।
রেশমা বলল, খালা মনে হয় ঘরেই আছে।
তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু শব্দটা কিসের?
মনে হয় ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নড়াচড়ার শব্দ।
তাই হবে।
এ সময় শব্দটা আরেকটু জোরে হলো। যেন অতিকষ্টে মেঝের একপাশ থেকে শরীর ঘষে ঘষে আরেক পাশে যাওয়ার চেষ্টা করছে কেউ। সঙ্গে কেমন ফোঁস ফোঁস একটা শব্দ! একটু যেন গোঙানির শব্দও শোনা গেল।
ওরা দুজন চিন্তিত চোখে দুজনার দিকে তাকাল।
রুবিনা বলল, এমন শব্দ হচ্ছে কেন?
রেশমা বলল, বুঝতে পারছি না।
চল ঘরে ঢুকি। দেখি ব্যাপারটা কি!
রুবিনার হাত ধরল রেশমা। আমার ভয় করছে। ঘরে ঢোকার দরকার নেই। চল চলে যাই।
আরে না, ভয়ের কিছু নাই। খালা একা একা বাড়িতে থাকে, তার তো অসুখ-বিসুখও হতে পারে! দেখা গেল ফিট হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে...
ফিট হলে শব্দ করবে কেমন করে?
এখন এত প্রশ্ন করিস না তো? আয় আমার সঙ্গে।
ওরা দুজন বিবির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, আলতো করে দরজা ধাক্কা দিল। তারপর যে দৃশ্য দেখল, দুজনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে বিবিখালা। পুরো শরীর প্যাঁচিয়ে বাঁধা, মুখে স্কচটেপ লাগানো। এ অবস্থায় বিবি চেষ্টা করছে শরীরের বাঁধন খোলার, তার মোচড়া-মুচড়ির শব্দটাই পাচ্ছিল রেশমা রুবিনা। মুখে শব্দ করতে পারছে না খালা, নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ বেরুচ্ছে, গোঙানির মতো শব্দ বেরুচ্ছে।
ওদেরকে দেখে ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে ইশারা করতে লাগল বিবি, গোঙানির শব্দটা বাড়ল। রেশমা রুবিনা সব ভুলে খালাকে গিয়ে ধরল। রুবিনা আস্তে আস্তে টেনে মুখ থেকে স্কচটেপ খুলল। বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। একবারে হেঁচকা টানে স্কচটেপ খুলতে গেলে স্কচটেপের সঙ্গে মুখের চামড়াও উঠে যেতে পারে।
মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিবি বলল, বাঁধন খোল, তাড়াতাড়ি বাঁধন খোল।
সে কথা বলার আগেই দ্রুত হাতে তার বাঁধন খোলার চেষ্টা করছিল রেশমা। কিন্তু শক্ত দড়িতে এমন প্যাঁচিয়ে বাঁধা, এমন গিঁট লেগেছে, সেই গিঁট খোলাই যাচ্ছে না।
বিবি বলল, কেটে ফেল, দড়ি কেটে ফেল। রুবিনা, রান্নাঘরে গিয়া বঁটি নিয়া আয়। বঁটি দিয়া কাট। তাড়াতাড়ি কর মা। তাড়াতাড়ি।
রুবিনা দৌড়ে গিয়ে বঁটি আনল, সাবধানে দড়ির বাঁধন কেটে বিবিকে মুক্ত করল। সঙ্গে সঙ্গে ওঠে বসল বিবি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, পানি খাওয়া, আমারে এক গ্লাস পানি খাওয়া।
ঘরের কোণে পিতলের একটা পানির কলস রাখা আছে। কলসের কাছেই আছে গ্লাস। রেশমা ছুটে গিয়ে পানি ঢেলে আনল, শিশুর মুখের সামনে গ্লাস ধরে যেভাবে পানি খাওয়ায় মায়েরা ঠিক সেইভাবে পানি খাওয়াল বিবিকে। বিবি তখন এক হাতে আরেক হাত ঘষছে। শক্ত করে বাঁধার ফলে গভীর দাগ পড়েছে হাতে।
পানি খেয়ে একটু সুস্থির হলো বিবি। রুবিনা উতলা গলায় বলল, তোমার এই অবস্থা কে করল খালা? ঘটনা কী?
বিবি বলল, লোকজন ডাক। আশপাশে যারা আছে সবাইরে ডাক। ভাইর স্কুলে খবর দে, আপার স্কুলে খবর দে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বল। ঘটনা খুব খারাপ।
রেশমা রুবিনা দুজনেই ছুটে বেরুতে চাইল। বিবি বলল, দুজনের যাওয়ার দরকার নাই। আমার ভয় করছে। একজন আমার কাছে থাক, একজন যা।
রেশমা বলল, রুবিনা, তুই যা। আমি খালার কাছে থাকি। রুবিনা ছুটে বেরিয়ে গেল।
চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকে ভরে গেল দিপুদের বাড়ি। রেশমার মা-বাবা ছুটে এলো, রুবিনাদের বাড়ির সবাই ছুটে এলো। রাস্তার ওদিকে যেসব বাড়িঘর সেইসব বাড়িঘরের লোকজনও এলো। নুরু মোল্লা মোবাইলে ফোন করে দিয়েছে সিরাজ মাস্টারকে। তিনি ফোন করেছেন আমেনা ম্যাডামকে। চারদিকে হুলুস্থূল পড়ে গেল।
ঘটনা কী? এভাবে কারা বাঁধল বিবিকে! কেন বাঁধল?
কিন্তু বিবি কোনো কথা বলছে না। ফ্যাল ফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। চোখে এখনো ভয় আতঙ্কের দৃষ্টি। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে সে।
রুবিনার ছোট চাচা হানিফ বলল, কারা তোমাকে এভাবে বাঁধল? ডাকাত এসেছিল নাকি বাড়িতে? বল, কী হয়েছিল বল?
বিবি রেশমার দিকে তাকাল। আরেক গ্লাস পানি দে মা।
রেশমা পানি নিয়ে এলো। এবার নিজ হাতেই পানি খেল সে।
সোনা মিয়া বলল, কথা বলছ না কেন? ঘটনা তো বলতে হবে! না হলে আমরা বুঝব কী করে কী হয়েছিল। থানায়ও খবর দেওয়া উচিত।
নুরু মোল্লা বলল, চুপ করে আছ কেন? বল আমাদেরকে কীভাবে কী হলো? কারা কখন কীভাবে এলো বাড়িতে? বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে গেল কী না?
রুবিনার মা, রেশমার মা, পাড়ার অন্যান্য মহিলা বিবির পাশে। তারাও বলল, ঘটনা বল। কী হয়েছিল খুলে বল।
বিবি কথা বলে না।
রুবিনা বলল, বল খালা, কথা বল।
রেশমাও বলল। কিন্তু বিবি কথা বলছে না।
রাস্তার মুখে বদরুলদের বাড়ি। সে কলেজে পড়ে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। বুদ্ধিমান ছেলে। বলল, আমার মনে হয় স্যার ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত সে কিছু বলবে না। তারা দুজনেই খবর পেয়েছেন। দেখি অপেক্ষা করে। তারা আসুক।
এই বদরুলই দিপুর কথা তুলল। দিপু কোথায়? ওর তো এ সময় বাড়িতে থাকার কথা। আজ ওদের স্কুলে ক্লাস হয়নি। দিপু বাড়ি ফেরেনি?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ।
নুরু মোল্লা বিবিকে জিজ্ঞেস করল, দিপু কোথায়? সে বাড়িতে আসেনি?
বিবি কথা বলল না।
সোনা মিয়া একটু বিরক্ত হলো। এই মহিলাকে নিয়ে দেখি আরেক যন্ত্রণা হলো! কোনো কথারই জবাব দিচ্ছে না! রহস্যটা কী?
বিবির দিকে তাকাল সে। আরে কথা বল! কথা না বললে আমরা বুঝব কী করে ঘটনা কী!
তখনও দু-চারজন করে লোক ঢুকছে বাড়িতে। এইসব লোকের দিকে তাকিয়ে সোনা মিয়া বলল, চারদিকে খবর হয়ে গেছে। এত লোকজন আসছে বাড়িতে, দিপু আসছে না কেন? ছেলেটা গেল কোথায়?
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিশেহারা ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলেন আমেনা ম্যাডাম আর সিরাজ মাস্টার। যে যার স্কুল থেকে ছুটে বেরিয়েই রিকশায় চড়েছেন। দু-রিকশাঅলাই ঝড়ের বেগে রিকশা চালিয়ে এসেছে।
আমেনা ম্যাডাম বাড়িতে ঢুকেই বিবির কাছে ছুটে এলো। কী হয়েছে? এ্যাঁ, কী হয়েছে?
বিবি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
সিরাজ মাস্টার তাকে একটা ধমক দিলেন। কান্নাকাটি কর না। ঘটনা বল। কী হয়েছে বল তাড়াতাড়ি। কারা এলো বাড়ি, কখন এলো! জিনিসপত্র কী নিয়ে গেল! বল, তাড়াতাড়ি বল।
বিবি নিজেকে সামলাল। অাঁচলে চোখ মুছে যা বলল তা এইরকম...
বিবির মুখে শোনা ঘটনা
আজ একটু তাড়াতাড়িই রান্নাবান্না শেষ হলো বিবির।
এই বাড়িতে ইলিশ খুব পপুলার। বাজারে বড় সাইজের ভালো ইলিশ পেলেই কিনে আনেন সিরাজ মাস্টার। ফ্রিজে ইলিশ দু-চারটা সব সময়ই থাকে। ইলিশের নানান পদ করতে ওস্তাদ বিবি। সিরাজ মাস্টার পছন্দ করেন কড়কড়ে ইলিশ ভাজা আর ঘন মুসরি ডাল। দু-টুকরা ওরকম ইলিশ ভাজা আর কয়েক চামচ ডাল হলে তার আর কিছু লাগে না। দেড়-দু প্লেট ভাত খেয়ে ফেলবেন।
আমেনা ম্যাডাম পছন্দ করেন বেগুন ইলিশ। মাছ না ভেজে বেগুনের সঙ্গে একটু বেশি ঝোল, ওরকম তরকারি হলে তিনি খুবই খুশি। হেড মিসট্রেস হওয়ার পর একটু মুটিয়েছেন। এ জন্য ভাত বেশি খান না। কিন্তু বেগুন ইলিশ হলে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেন না। পরিমাণের তুলনায় তিন-চার চামচ ভাত বেশিই খেয়ে ফেলেন। এ জন্য বিবিকে তিনি বলেছেন, আমাকে জিজ্ঞেস না করে বেগুন ইলিশ করবে না। যেদিন আমি বলব সেদিন করবে। তবে আমি বললেও ঘন ঘন করবে না। মাসে বড়জোর দুবার।
সেইভাবেই চলছে বিবি।
কিন্তু ম্যাডাম তার কথা মতো চলতে পারছেন না। সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় হয়তো বললেন, বিবি, আজ বেগুন ইলিশ কর।
বেগুন ইলিশের হিসেবটা বিবি রাখে। সে বলল, আজ সেটা করা ঠিক হবে না আপা।
কেন?
আট দিন আগেই তো করলাম।
শুনে লাজুক হাসেন ম্যাডাম। তাহলে থাক।
সিরাজ মাস্টার হয়তো পাশেই ছিলেন। হাসিমুখে বললেন, তাহলে আজ আমারটা কর। ভাজা ইলিশ আর ঘন মুসরি ডাল। আমার তো মোটা তাজার সমস্যা নেই।
বিবি বলল, না, আজ আপনাদের কোনোটাই করা যাবে না ভাই। আজ ঋতু দিপুর পছন্দেরটা করব। সরিষা ইলিশ।
দুভাই বোনের পছন্দ সরিষা ইলিশ। ওই জিনিস হলে তারা আর দিকপাশ ভাবে না। খুবই মজা করে খায়।
ঋতুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, বাড়িতে এখন দিপুর জন্যই সরিষা ইলিশ করতে হয়। পছন্দ কম বেশি সবারই, তবে দিপুর খুব বেশি। যেমন সিরাজ মাস্টারের ভাজা ইলিশ, আমেনা ম্যাডামের বেগুন ইলিশ।
ঋতু নিজের পছন্দটা তার বরকেও ধরিয়ে দিয়েছে। মোহিতের খুব প্রিয় এখন সরিষা ইলিশ। বিয়ের আগে মাছ সে পছন্দ করত না। সে হচ্ছে মাংসের ভক্ত। এখনো মাংসের আকর্ষণ তার কমেনি, সঙ্গে যোগ হয়েছে সরিষা ইলিশ। বিবির কাছ থেকে সরিষা ইলিশ রান্নাটা খুবই ভালো শিখেছে ঋতু। ছুটি ছাঁটার দিনে বরকে রান্না করে খাওয়ায়। এই বাড়িতে বেড়াতে এসেও কোনো কোনো সময় করে। সাধারণত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে আসে। শুক্রবার পুরোটা দিন থাকে, রাতটা থাকে, শনিবার দুপুরের খাওয়া টাওয়া সেরে ঢাকায় চলে যায়। পরদিন অফিস।
মায়ের চেয়ে বাবার সঙ্গে ভাবটা ঋতুর বেশি। যেদিন সে আসবে তার আগের দিন বাবাকে ফোন করবে। বাবা আমি কাল আসব। সকালবেলা উঠেই তুমি...
বাকিটা বলে দেন সিরাজ মাস্টার। বাজারে যাব। তাজা বড় ইলিশ কিনে আনব।
হ্যাঁ। অন্য ভালো মাছও আনবে। তবে ইলিশ মাস্ট।
সিরাজ মাস্টার সেই মতো ব্যবস্থা করেন।
পরদিন সন্ধ্যায় ঋতু মোহিত তাদের গাড়ি নিয়ে হাজির। সঙ্গে আছে ড্রাইভার ফারুখ।
বাড়িতে মেয়ে এলেই একটা উৎসব শুরু হয়। দিপু সেদিন আর বই নিয়ে বসে না। দুলাভাইয়ের সঙ্গে হাসি মজায় মেতে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে গল্প করে। মোহিত চাঁদ পাগল লোক। পূর্ণিমা রাতে শ্বশুরবাড়িতে সে আসবেই। সন্ধ্যাবেলা চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দিপুকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। অনেকটা রাত পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে। কখনো কখনো ঋতুও যায় তাদের সঙ্গে। ঋতু এক সময় রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিল। কুসুমপুরের হরিনাথ মজুমদার রবীন্দ্রসংগীতের নামকরা ওস্তাদ। তার কাছেই শিখেছিল। ঋতুর গলাও খুব মিষ্টি। বিয়ের পর চর্চা আর করে না। তবু পূর্ণিমা রাতে তারা তিনজন যখন বেড়াতে বেরোয়, মোড়লদের মেহগনি বাগানের ওদিককার নির্জনে এসে ঘাসের ওপর বসে তিনজন। মোহিত বলে, গান গাও ঋতু।
গানের ব্যাপারে ঋতুর ভান ভনিতা নেই। যারা গান করে তারা সাধারণত গান গাইতে বললেই গান ধরে না। একটু গাইগুই করে। গলা ঠিক নেই। কাশি হয়েছে। আজ থাক ইত্যাদি। ঋতুর ওসব নেই। সে সঙ্গে সঙ্গেই গাইতে শুরু করে।
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
মোহিতের জন্য রবীন্দ্রনাথের চাঁদ বিষয়ক গানগুলো সে শিখে নিয়েছে। ওই গানটাও ভালো গায়।
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছ যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছ যে দান
এই গানের একটা লাইন আছে
তোমার চাঁদের আলোয় মিলায় আমার
দুঃখ সুখের সকল অবসান
লাইন দুটো খুব প্রিয় মোহিতের। স্বামীর পছন্দটা জানে ঋতু। এ জন্য এই লাইন দুটো সে খুবই দরদ দিয়ে গায়। মোহিত মুগ্ধ হয়ে শোনে।
ঋতু একটু মুডি টাইপের মেয়ে। সকালবেলা উঠে হয়তো বিবিকে বলল, আজ আমি সরিষা ইলিশ করব। মাছ কেটেকুটে রেডি কর।
সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে লেগে যায় বিবি। ঠিক আছে মা। কর তুমি।
আজ এই বাড়িতে সরিষা ইলিশ হয়েছে। সকালবেলা ওঠেই দিপু বলেছে সরিষা ইলিশ খাবে। স্কুলের মিলাদ শেষ করেই বাড়ি আসবে। এজন্য রান্নাটা তাড়াতাড়ি সেরেছে বিবি। অন্যান্য দিন একটু আস্তে ধীরে সারলেও অসুবিধা হয় না।
রান্না শেষ করে গোসলে যাবে বিবি, দিপু আসার আগেই গোসল সেরে রাখবে যাতে দিপু আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভাতটা তাকে দিতে পারে। এ সময় কলিংবেল বাজল। তখন একটার মতো বাজে।
বিবি একটু অবাক হলো। দিপু এত তাড়াতাড়ি এসে পড়ল? বলে গেছে দেড়টার দিকে আসবে? মিলাদ কি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!
সে গেট খুলল। তিনটা অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একজন দিপুর বয়সী, অন্য দুজন বড়। যুবক ছেলে। দুই যুবকের একজন প্যান্টের দুপকেটে দুহাত ঢুকিয়ে রেখেছে। অন্যজনের পেটের কাছটা ফোলা।
বিবি অবাক। তোমরা কারা?
বড় দুজন কথা বলল না, বলল দিপুর বয়সী ছেলেটা। আমার নাম আরিফ। দিপুর সঙ্গে পড়ি। দিপুর আসতে একটু দেরি হবে। মিলাদের পর স্কুলে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। দিপু পাঠাল তার ব্যাট নিতে। সে খেলবে নিজের ব্যাট দিয়ে।
বিবি চিন্তিত হলো। দিপুর তো ক্রিকেট ব্যাট নেই।
যুবক ছেলে দুটোর একজন বলল, আছে। দিপু আমাদেরকে বলেছে আপনার ঘরে একটা ব্যাট সে লুকিয়ে রেখেছে। ওটা নিতেই আমাদের পাঠাল। স্যার তো ক্রিকেট খেলা পছন্দ করেন না, এজন্য ব্যাট আরিফের বড় ভাইকে দিয়ে ঢাকা থেকে কিনে আনিয়েছে। এনে আপনার ঘরে লুকিয়ে রেখেছে।
না, আমার ঘরে দিপু কিছু লুকিয়ে রাখলে আমি জানতাম। আমারে সে বলত।
অন্য যুবক বলল, আপনাকে বলতে ভুলে গেছে। আপনার ঘরের কোথায় ব্যাট রেখেছে আমাদেরকে বলে দিয়েছে। চলেন বের করে দিচ্ছি।
বিবি তারপরও গেট থেকে সরে দাঁড়াল না। যদি আমার ঘরে ব্যাট রেখেও থাকে তাহলে সেটা নিতে দিপু আসবে। তোমাদেরকে পাঠিয়েছে কেন?
ছোট ছেলেটা বলল, দিপু খেলছে। সে আসতে পারেনি দেখেই আমাদেরকে পাঠিয়েছে। বলল, খালাকে গিয়ে বললেই হবে।
বিবি সন্দেহের চোখে ওদের দিকে তাকাল। যুবক দুটিকে বলল, তোমরা তো বয়সে অনেক বড়। এই বয়সেও স্কুলে পড়?
এক যুবক বলল, না। আমরা স্কুলে পড়ি না। লেখাপড়া অনেক আগে শেষ করেছি। থাকি ঢাকায়। আরিফদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। ওরা আমাদের আত্দীয়। দিপু ওকে ব্যাট নিতে পাঠাল দেখে সঙ্গে এসেছি।
তাহলে তোমরা জানলা কী করে ব্যাট কোথায় লুকায়া রাখছে দিপু?
অন্য যুবক বলল, আমাদের সামনেই আরিফকে বলেছে। আন্টি, আপনি কি আমাদেরকে খারাপ ছেলে ভাবছেন? যদি ওরকম ভাবেন তাহলে দরকার নেই ব্যাটের। এই আরিফ চল। দিপুকে গিয়ে বল ওদের বাড়ির বুয়া ব্যাট দেবে না।
বিবি একটু নরম হলো। না না ব্যাট দিব না এটা বলি নাই। ঠিক আছে তোমরা দাঁড়াও আমি ব্যাট নিয়া আসছি।
কীভাবে আনবেন। আপনি তো জানেনই না ব্যাট কোথায়?
বলে দাও কোথায় রাখছে?
বললেও আপনি খুুঁজে পাবেন না। আমরা আপনার সঙ্গে আসি। আমাদের নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা খারাপ ছেলে না, চোর ছ্যাচড় না। আরিফ দিপুর সঙ্গে পড়ে। ওদের বাড়ি পাড়াগাঁও। পাড়াগাঁও মোল্লাবাড়ির ছেলে। নামকরা পরিবার।
কিন্তু ওকে কখনো দিপুর সঙ্গে দেখি নাই।
আরিফ হাসিমুখে বলল, সিরাজ স্যারকে আমি যমের মতো ভয় পাই। এ জন্য এই বাড়ির দিকে আসি না। স্কুলেই দিপুর সঙ্গে আড্ডা দিই। খেলাধুলা করি। আন্টি, তাড়াতাড়ি করেন। দেরি হলে দিপু রাগ করবে।
এত আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা, বিবির আর কিছু মনেই হলো না। বলল, ঠিক আছে, আসো আমার সঙ্গে।
বিবির পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকল ওরা। বিবি খেয়াল করল না, এক যুবক নিঃশব্দে ভিড়িয়ে রাখল গেট।
বাড়িতে ঢুকে বিবির পিছু পিছু সোজা তার ঘরে ঢুকে গেল ওরা। বিবি ওদের দিকে তাকিয়ে মাত্র বলতে যাবে, কোথায় দিপুর ব্যাট, তার আগেই এক যুবক পেছন থেকে শক্ত হাতে চেপে ধরল তার মুখ। আরেক যুবক চট করে পকেট থেকে স্কচটেপ বের করে তার মুখে লাগিয়ে দিল। তারপর দ্রুত হাতে কোমরে প্যাঁচিয়ে রাখা দড়ি খুলে সেই দড়ি দিয়ে বাঁধল বিবিকে। বিবি সমানে ধস্তাধস্তি করছিল। যে যুবক মুখে স্কচটেপ লাগাল, দড়ি দিয়ে বাঁধল, বোঝা গেল সে-ই পালের গোদা। কারণ সে তার পকেট থেকে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করে বিবির ডানদিককার বাহুতে দ্রুত পুশ করে দিল। ইনজেকশন রেডি করাই ছিল। বিবি তারপর টের পেল চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না, শরীর অবশ হয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছে সে...
বিবির মুখে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেল লোকজন। সোনা মিয়া বলল, সিনেমা, একদম সিনেমার মতো ঘটনা।
হানিফ বলল, কিন্তু কী জন্য এমন করল ওরা? ডাকাতির কোনো চিহ্ন তো বাড়িতে দেখছি না। বিবির ঘরে ডাকাতি করার কিছু নেইও। মাস্টার সাবের বিল্ডিংয়ের দিকে তো ওরা যায়ইনি।
বিবি বলল, না যায় নাই। বাড়ির গেট সব সময় বন্ধ থাকে। তারপরও গোসলে যাওয়ার সময় বিল্ডিংয়ের গ্রিল দেওয়া দরজায় তালা দিয়া যাই আমি। চাবি থাকে আমার বালিশের তলায়। চাবি ওইখানেই আছে। চাবি ওরা ধরেই নাই। বিল্ডিংয়ের গেটে ওই যে দেখেন তালা ঝুলতাছে।
সবাই আবার সেদিকে তাকাল। সত্যি তাই। ওদিকটায় ওরা যায়ইনি। তাহলে কী উদ্দেশ্যে এমন করল?
তখন নতুন করে যেন দিপুর কথা মনে হলো সবার।
দিপুর তিন বন্ধু সাকিব, তূর্য, শাওন, ওরা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। শুধু দিপু কোথাও নেই। আমেনা ম্যাডাম সাকিবদের দিকে তাকালেন। উদাস গলায় বললেন, তোরা সবাই এখানে, দিপু কোথায়?
সাকিব বলল, দিপু তো মিলাদ শেষ করেই বাড়ি চলে এসেছে।
সিরাজ মাস্টার বললেন, বলিস কী? তাহলে সে গেল কোথায়?
তূর্য বলল, তা তো বলতে পারি না স্যার। মিলাদ শেষ হওয়ার পর আমাদের সঙ্গেই এলো। ও চলে এলো এই বাড়ির দিকে, আমরা চলে গেলাম যে যার বাড়িতে।
সিরাজ মাস্টার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমার ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। ঘটনা খুব খারাপ।
আমেনা ম্যাডাম বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।