দীর্ঘ মেয়াদী বন্যার কবলে পড়েছে লক্ষ্মীপুর। এতে করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এ জেলার বাসিন্দাদের। উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম কৃষি ও মৎস্যখাতও তছনছ হয়ে গেছে। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে বহু মানুষের। কেউ ঘর হারিয়েছেন, কেউ গবাদি পশু, স্বপ্নের মাছ ও কৃষি ফসল হারিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে অর্ধাহারে অনহারে জীবনযাপন করছেন। টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢলের পানি আর বৃষ্টির পানির জলাবদ্ধতায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ জীবন যুদ্ধে লড়ছেন হাজারো পরিবার। এখনো ১ লাখ ২১ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তুলনামূলক উঁচু এলাকাগুলো থেকে বন্যার পানি অনেকটা কমেছে। কিন্তু নিম্নাঞ্চলের বহু গ্রামে এখনো ঘরের ভেতর ও বাইরে হাঁটু পরিমাণ পানি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বাস করতে হচ্ছে অনেককে। এমনি একটি পরিবারের দেখা মিলে সদরের ঢাকা-রায়পুর সড়কের মান্দারী রতনেরখিল এলাকায়। খেটে খাওয়া শ্রমিক আবুল হোসেন ও শেফালী বেগম ৩-৪ জন শিশু (নাতি-নাতনি) কোলে একটি চৌকির উপরে বসে আছেন। সাংবাদিক দেখেই ক্ষেপলেন তারা। এ সময় শেফালী বলেন, পানিতে ডুবে রইছি দুই মাস, ঘরের ভিতরে এক হাঁটু পানি, কেউ সহযোগিতা করে না। শুধু ছবি তুলে নিয়ে যায়। এ পর্যন্ত দুইবার ঘর চুরি হয়েছে। রোদ উঠলে পানি কমে, বৃষ্টি আসলেই বুখ ধরপড় করে উঠে। আমাগো কেউ নেই।
এ সময় তার স্বামী আবুল হোসেন বলেন, আমরা এ দেশের নাগরিক, কিন্তু আমরা কিছুই পাই না, খুব কষ্টে আছি। এ পরিবারের পাশেই বাস করেন কাজলী বেগম, তারও একই অভিযোগ। পানিতে রান্না বান্না করতে পারছে না। চুলা নিভে আর জ্বলে। এমন পরিস্থিতি জেলার চরশাহী, দিঘলী, বাঙ্গাখা, লাহারকান্দি, কমলনগর ও রামগতিসহ জেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলে। এসব এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্রিজ কালভার্ট, রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেছে বহুস্তানে, খামার, মাছের ঘের, পুকুর, জলাশয়, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে পানির তোড়ে জেলার রহমতখালি, ওয়াপদা খালে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নদীপাড়ের মানুষের ঘরবাড়িও ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বন্যায় অন্তত ২০ হাজার মানুষের ঘর ভেঙ্গে গেছে। জানা যায় জেলার ১৮ লাখ মানুষের ৭০ ভাগই কৃষিজীবী। একমাত্র উপার্জনের মাধ্যমে আঘাত হানায় এসব এলাকার মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন অনেকে। সরকারি সহায়তার আশায় বসে আছেন অসহায় হাজার হাজার মানুষ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেলাল হোসেন জানান, বন্যায় ৪০ হাজার ১৮৫টি পুকুর ভেসে গেছে। ১০ হাজার ৪৩৯ মেট্রিক টন মাছ চলে গেছে চাষিদের। জেলায় মৎস্যখাতে ২৪৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, জেলায় ৩৯ হাজার হেক্টর ফসলি (আমন বীজতলা, আমনের চারা ও আউশ ধান, শরৎকালীন সবজি) জমি আক্রান্ত হয়েছে। এতে আড়াই লাখ কৃষক পরিবারের ২২৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে বন্যায় লক্ষ্মীপুর জেলায় ৬৫৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের ৬২টি, মাধ্যমিক-স্কুল এন্ড কলেজ ও কলেজের ৮৪টি এবং প্রাথমিকের ৫১৩টি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুদ রঞ্জন মিত্র বলেন, ৩৩১টি গবাদি পশুর খামার, ৪২৬টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বোমোট ১০ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ২শ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকরামুল হক জানান, প্রায় এক হাজার কিলোমিটার সড়ক এখন চলাচল অনুপযোগী। ১৪৯টি ব্রিজ কালভার্ট ভেঙ্গে গেছে। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলে পরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি জানা যাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তালিকা প্রেরণ ও বরাদ্দ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বিতরণ চলছে। ক্ষয়ক্ষতি ও পরবর্তী পুনর্বাসনে তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে, শীঘ্রই সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/এএ