বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলেই তার রাজনৈতিক সমাধান মেলে না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে তারা চোরাগোপ্তা কার্যক্রম চালিয়ে দেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। জনগণের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদায় যারা জায়গা করে নিতে পারবে না, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হারিয়ে যাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও নির্বাচন দিতে পারে, আবার চাইলে পাঁচ মাসের মধ্যেও দিতে পারে। এটা নির্ভর করছে তাদের আন্তরিকতার ওপর।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কী?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : সরকারের কাছে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নেই। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যেন পূরণ হয়, এটাই আমাদের লক্ষ্য। এই মুহূর্তে জনগণের প্রত্যাশা একটা সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নির্বাচনের প্রশ্নে সরকার পরিষ্কার করে কিছু বলছে না। জনমনে প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচনটা কবে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে একটা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এই সরকারে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নেই। সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা বেশির ভাগই সুশীল সমাজ, বিভিন্ন ধরনের এনজিও কিংবা প্রাক্তন সেনাসদস্য। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিভিন্ন সময় বিপ্লবী কথাবার্তা বলেন। একটা গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনায় না এলে দেশ সুষ্ঠুভাবে চলবে না।
সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে একেকজন উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় নির্বাচন কবে হতে পারে তা নিয়ে নিজস্ব মতামত দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে এখনো নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে দিন দিন জটিলতা বাড়ছে। একটা অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কখনোই নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের সমান হতে পারে না। বর্তমানে বাংলাদেশকে ঘিরে যেসব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা মোকাবিলা করতে রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই। একমাত্র রাজনৈতিক সরকারই পারবে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে।
বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে সরকারের কাছে রাজনৈতিক দলের কথার চাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কথা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষে এত এত রাজনৈতিক ইস্যু মোকাবিলা করা সম্ভব না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার জন্য। আপনার মতে এই যৌক্তিক সময়টা কবে নাগাদ হতে পারে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : যৌক্তিক সময় নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি আমার বাড়িতে একটা ভোজের আয়োজন করব। এখন আমাকে হিসাব করতে হবে, কতজন লোকের জন্য আয়োজন করব, কীভাবে করব, কী কী জিনিস লাগবে, সেসব জিনিস কোথায় পাওয়া যাবে। এসব হিসাবপত্র করে তারপর আমাকেই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে যে কবে নাগাদ অনুষ্ঠানটা করা যাবে। যৌক্তিক সময়টাও ঠিক এভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেই আসতে হবে।
তবে সবকিছুরই একটা সময়সীমা আছে। দরজির দোকানে স্যুটের অর্ডার দিলে দরজিও ডেলিভারির জন্য একটা তারিখ দেয়। সেটা হয় এক মাস কিংবা এক সপ্তাহ। সে যদি মনে করে স্যুটটা জরুরি প্রয়োজন তবে ইচ্ছা করলে অর্ডার দেওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও সে এটা বানিয়ে দিতে পারে। একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও নির্বাচন দিতে পারে, আবার চাইলে পাঁচ মাসের মধ্যেও দিতে পারে। এটা নির্ভর করছে তাদের আন্তরিকতার ওপর।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য কিংবা নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণার দাবি উঠছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : বিভিন্ন কর্মকান্ড দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের অযোগ্য ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। দলগুলোর একেকটির অবস্থান জনগণের কাছে একেক রকম। কোনো কোনো দল নামে মাত্র টিকে আছে। তাদের নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। জনগণই এসব দলের বিষয়ে তাদের রায় দিয়ে দিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তারা চোরাগোপ্তা কার্যক্রম চালাবে। দেশকে আরও বেশি করে অস্থিতিশীল করে তুলবে। তখন তাদের গতিবিধি অনুসরণ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলা করা যত সহজ, অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করা তত কঠিন। বাংলাদেশ এখন অদৃশ্য শত্রু দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে, এটাকে দৃশ্যমান রাখতে না পারলে মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, দল নিষিদ্ধ করাটা একমাত্র সমাধান নয়। জামায়াতকেও তো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে গিয়েছিল, কিন্তু জামায়াতকে দেখলে এখন মনে হয় বেশ সতেজতার সঙ্গে তারা সরকারে আছে। বিএনপি যা বলে তা না হলেও জামায়াত যখন যা বলছে তা-ই হচ্ছে। কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলেই তার রাজনৈতিক সমাধান মেলে না। জনগণের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদায় যারা জায়গা করে নিতে পারবে না তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জাতীয় নির্বাচনের জন্য আপনারা কতটুকু প্রস্তুত।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : সরকার যদি আগামীকাল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে তাহলে বিএনপি আগামীকালই অংশ নিতে পারবে। বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। গত ১৭ বছর আন্দোলন করছি, এর চেয়ে বড় প্রস্তুতি আর কী হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার বলছেন, আগামী নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। চ্যালেঞ্জের জায়গাগুলো কোথায়।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন যে কোনো দিক দিয়েই চ্যালেঞ্জিং। এখানে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো সুযোগ থাকবে না। ভোটারদের মন জয় করে বিজয় ছিনিয়ে আনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : উনি কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের রাষ্ট্র শাসনে তারেক রহমানের জন্য দৃশ্যমান কতগুলো বাধা তৈরি করেছেন। সেই বাধাগুলো এখনো দূরীভূত হয়নি। রাজনৈতিক মহলে ওয়ান-ইলেভেনের কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এখন ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নাকি ‘মাইনাস টু পার্টি ফর্মুলা’ চলছে? সব বাধা দূর হয়ে গেলেই তিনি দেশে ফিরবেন বলে আমি আশা করছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি উঠছে। এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের কাছে আপনার বক্তব্য কী?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : এটা বাস্তবায়ন করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না। বন্দিবিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে শেখ হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হতে হবে। শেখ হাসিনা এখনো আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। এ বিষয়ে আমি অন্য একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। তাকে যেতে দেওয়া হলো কেন? আওয়ামী লীগের এত এমপি-মন্ত্রীকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনতে পারলে সেটা উত্তম হতো।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : আপনাদেরও ধন্যবাদ।