শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

রোজা পালন ও আত্মার সংশোধন

মুফতি আমজাদ হোসাইন

রোজা পালন ও আত্মার সংশোধন

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী।  কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না, যাতে তোমরা গণনা পূরণ করতে পার এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (সুরাতুল বাকারা : ১৮৫) আলোচ্য আয়াতে রমজানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, কর্মপন্থা বাতলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বিস্তারিত আলোচনা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কারণ  কোরআন হলো সব মূলনীতির শিরোনাম। আর হাদিস হলো সেই শিরোনামের ব্যাখ্যা।  পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। অল্পতে অনেক সাওয়াব হাসিল করার মাস। এক মাস মেহনত মুজাহাদা করে নিজের নেকির পাল্লা ভারি করা এবং বদির পাল্লা হাল্কা করার মাস। ইসলামের প্রতিটি ইবাদত প্রবর্তনের পেছনে  বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। যখন কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য হাসিল হয় তখনই পালনীয় ইবাদতের পূর্ণ ফায়দা পাওয়া যায়। রোজা পালনের পেছনেও মহান রাব্বুল আলামিনের মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হলো বান্দাকে পাপমুক্ত করা এবং জাহান্নামের মুক্তির ফায়সালা করা। এখন আমাদের বুঝতে হবে সিয়াম সাধনা দ্বারা কীভাবে গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং পূর্ণ ফায়দা পাওয়া যায়? তা আমাদের প্রতিটি রোজাদার ভাইয়ের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে  বুঝতে পারব যে মানুষের অধিকাংশ গুনাহের সম্পর্ক দুটি জিনিসের সঙ্গে। সেই জিনিসদ্বয় যদি নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায় তখন মানুষ অধিকাংশ গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকে। জিনিস দুটি হলো এক. পেট. দুই যৌন সংক্রান্ত বিষয়। রমজানের সংজ্ঞায় এই জিনিস দুটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সুর্যাস্ত পর্যন্ত এ দুটি বস্তুকে হারাম করা হয়েছে। একজন ব্যক্তি যখন একটি মাস প্রতি দিবসে নিজেকে সমস্ত হারাম থেকে মুক্ত রাখবে বাকি এগারোটি মাসও হারাম থেকে মুক্ত থাকার অভ্যাস গড়ে উঠবে। একটু চিন্তা করলে বুঝে আসবে যে মাহে রমজানের রোজা দ্বারা শুধু আলোচ্য বস্তু দুটির নিয়ন্ত্রণই হয় না, তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোরও নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়। কারণ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর গোনাহ থেকে মুক্ত থাকলেই রোজা পূর্ণাঙ্গ হয় এবং পূর্ণাঙ্গ রোজার ফায়দা পাওয়া যায়। অর্থাৎ (১) রোজা অবস্থায় মুখের সমস্ত গুনাহ থেকে হেফাজত থাকতে হবে। মিথ্যা, গিবত- শেকায়েত, পরনিন্দাহ ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। (২) চোখের গুনাহ। অর্থাৎ হারাম বস্তুর দিকে তাকানো বা তাকানোর চিন্তা সম্পূর্ণ রূপে ছেড়ে দিতে হবে। (৩) কানের গুনাহ অর্থাৎ সমস্ত হারাম বস্তু শ্রবণ থেকে নিজের কানকে হেফাজত রাখতে হবে। এর যেমন রোজা সঠিক হবে তার সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের নফসেরও ইসলাহ বা সংশোধন  হবে। ‘ইসলাহ’ শব্দের অর্থ সংশোধন। ‘নফ্স’ শব্দের অর্থ আত্মা। এক কথায় আত্মার সংশোধন। বুখারি শরিফের এক হাদিসে এসেছে, ‘রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মানুষের ভিতরে এমন একটি টুকরা আছে ওই টুকরাটি যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে মানবদেহের পুরো অংশ পরিশুদ্ধ হয়। কিন্তু যদি ওই টুকরাটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে মানবদেহের পুরো অংশ নষ্ট হয়ে যায়। সেই অংশটির নাম হলো আত্মা’। ইসলাম ও শরিয়তের সম্পর্ক হলো, মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে। বাহ্যিক শরিয়তের বিধি-বিধান বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন— নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি বিধানসমূহ। পক্ষান্তরে অভ্যন্তরীণ শরিয়তের বিধি-বিধান অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন কুচরিত্র দূর করে সুচরিত্র অর্জন করা, ইখলাস হাসিল করা, আল্লাহ ও তার রসুলের মহব্বত লাভ করা ইত্যাদি। আর অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা  রুহের  সঙ্গে  সম্পৃক্ত  আমলগুলো  দুই ভাগে বিভক্ত। এক. এমন কিছু গুণ আছে যা করণীয়। দুই. কিছু গুণ এমন আছে যা বর্জনীয়। করণীয় গুণসমূহ হলো—  উত্তম চরিত্র, যা কলবের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাকে আখলাকে হামিদা (উত্তম চরিত্র), আখলাকে হাসানা (সুন্দর চরিত্র), মালাকাতে ফাজেলা (উত্তম জ্ঞান) ও মাকামাত (আধ্যাত্মিক স্তর) বলা হয়ে থাকে। সুতরাং মানুষের বাহ্যিক বিধানাবলী, যেমন—  নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত ইত্যাদিকে সঠিক ও সহিহভাবে আদায় করা জরুরি যা কেউ কখনো অস্বীকার করবে না, তেমন অভ্যন্তরীণ বিধানগুলো, তাওহিদ, ইখলাস, তওবা, হুব্বে ইলাহী, খোদা প্রেম ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংশোধন করাও অতীব জরুরি বরং বাহ্যিক বিধান সঠিক হওয়া অভ্যন্তরীণ বিধান সঠিক হওয়ার ওপর ভিত্তি। কোরআন ও হাদিসে বাহ্যিক বিধান পালনের ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমন অভ্যন্তরীণ বিধানের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বরং অভ্যন্তরীণ বিধানাবলীর ব্যাপারে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন—  কোরআন পাকের বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার নিয়ম হলো, সাধারণ কোনো কথা স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কোনো কসম বা তাকিদের শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু বিষয়টি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তখন একটা কসম বা দুটো কসম ব্যবহার করে বিষয়টি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। কিন্তু ‘তাজকিয়ায়ে নফস’ তথা ‘এহসান’ ও আত্মশুদ্ধি হাসিল করার ব্যাপারে সুরা শামসের ৯ ও ১০ আয়াতে সাতটি বিষয়ের কসম করে আল্লাহপাক বলেন, যে ব্যক্তি নিজেকে শুদ্ধ করে, সে সফলকাম হয়  আর যে ব্যক্তি নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। উপরোক্ত আয়াত দুটিতে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি কীভাবে হাসিল হয় তার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। আর পবিত্র রমজানের রোজা পালন দ্বারা মানব আত্মার সংশোধন হয়।  আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে রোজা পালনের মাধ্যমে সঠিকভাবে আত্মশুদ্ধি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর