কিংবদন্তি ফুটবলার আবদুস সালাম মূর্শেদী, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার স্ব-স্ব অঙ্গনে ছিলেন উজ্জ্বল তারকা। অর্থবিত্ত নামডাক কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। খেলোয়াড় কিংবা শিল্পী হিসেবে তাঁদের সবাই একনামে চিনত, সম্মান করত, ভালোও বাসত। কিন্তু রাজনীতির চক্করে পড়ে আজ তাঁরা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত। কেউ রয়েছেন কারাগারে, কেউ বিদেশে পলাতক জীবনযাপন করছেন। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। তাঁরা যে যে ক্ষেত্রে তারকা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেখানে থেকেই দেশ ও জাতিকে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন, নিজেরাও সমাদৃত হতে পারতেন। কিন্তু রাজনীতির কুহক তাঁদের ফেলে দিয়েছে এমন গাড্ডায়, যেখান থেকে আর উঠে আসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মোহামেডানের সালাম মূর্শেদী একসময় কাঁপাতেন ঢাকা স্টেডিয়াম। তাঁর পায়ে বল গেলে হৃৎকম্প সৃষ্টি হতো প্রতিপক্ষ টিমের খেলোয়াড়দের। ঢাকার ফুটবল ইতিহাসে যে কজন খেলোয়াড় কিংবদন্তি হয়ে আছেন, সালাম মূর্শেদী তাঁদের একজন। তাঁর আগে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের কাজী সালাউদ্দিন এক মৌসুমে ২৪টি গোল করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সে রেকর্ড ভাঙেন সালাম মূর্শেদী। এক মৌসুমে ২৭টি গোল করেন তিনি। সে সময় ঢাকা সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লিগে এটাই ছিল সর্বোচ্চ গোল দেওয়ার রেকর্ড। আমরা যারা মোহামেডানের সমর্থক, তারা সালাম মূর্শেদীকে নিয়ে অহংকার করতাম। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ব্যবসাবাণিজ্য করে বেশ ভালোই ছিলেন তিনি। হয়েছিলেন বিজিএমইএর সভাপতিও। কিন্তু যেদিন তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে খুলনার একটি আসন থেকে বিনা ভোটে এমপি হলেন, ভক্তরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের খ্যাতি অর্জনকারী এই তারকা ক্রিকেটার বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছিলেন। দলমতনির্বিশেষে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। শিশুরা সাকিব হতে চাইত। শুধু বাংলাদেশ নয়, তাঁর পরিচিতি-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর ভক্তের সংখ্যাও কম ছিল না। লেখক জাকারিয়া পলাশ তাঁর ‘কাশ্মীর, ইতিহাস ও রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, কাশ্মীর ভ্রমণের সময় তিনি সেখানকার প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে তার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। তবে সশরীরে নয়, নামে। এক বালক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? উত্তরে জাকারিয়া পলাশ বাংলাদেশ বলতেই বালক উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, ‘ওহ! সাকিব আল হাসানের দেশ?’ খেয়াল করুন, কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামের এক বালকের কাছে বাংলাদেশের পরিচয় সাকিবের দেশ হিসেবে। এটা কি কম প্রাপ্তি ছিল সাকিবের? তারপরও তিনি কেন রাজনীতির ডোবায় নেমেছিলেন ডুব-সাঁতার দিতে? কিসের অভাব ছিল তাঁর, যেটা রাজনীতি তাঁকে দিতে পারত? এমপি-মন্ত্রী? সবাইকে এমপি-মন্ত্রী হতে হবে এমন কোনো কথা আছে? একজন এমপি বা মন্ত্রীর চেয়ে সাকিব আল হাসানের জনপ্রিয়তা, সম্মান কি কম ছিল? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন-কী পেয়েছেন তিনি রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে? হ্যাঁ, ২০২৪-এর ভুয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি পদবির মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু বিনিময়ে তাঁকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। একজন খেলোয়াড়ের আজীবনের আকাঙ্খা থাকে দেশের মাটিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাঁর খেলোয়াড়-জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা অর্থাৎ অবসর নেওয়ার। সাকিবের ভাগ্যে সেটা জোটেনি। তাঁকে অবসরের ঘোষণা দিতে হয়েছে বিদেশে অবস্থান করেই। এখন তিনি হত্যা মামলার আসামি। সাকিব অপরাধ করেছেন কি করেননি, তার বিচার হবে আদালতে। কিন্তু জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করে তিনি যা অর্জন করেছিলেন, তা বিসর্জন দিয়েছেন রাজনীতির নরককুণ্ডে।
সাকিবের মতোই আরেক ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে অবস্থান আজ তৈরি হয়েছে, তাতে এই তারকা ক্রিকেটারের অবদান অপরিসীম। তিনিও রাজনীতিতে ঢুকে দর্শক-ভক্তদের একটি বড় অংশের হৃদয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর তাঁর গ্রামের বাড়ি ভেঙে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। মাশরাফি যদি রাজনীতিতে না জড়িয়ে ক্রিকেট নিয়েই থাকতেন, তাহলে হয়তো উঠে যেতে পারতেন অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু রাজনীতির মোহমায়া তাঁকে ভূতলে পতিত করেছে।
‘মমতাজ’, যাকে বলা হতো বাংলা ফোকগানের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী, যিনি তাঁর কণ্ঠের জাদুতে সবাইকে মুগ্ধ করে ভক্ত বানিয়েছিলেন। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে মমতাজ সংগীত সাধনা করে উঠে গিয়েছিলেন পর্বতসম উচ্চতায়। কিন্তু রাজনীতির মোহে পড়ে আজ তিনি গিরিখাদে পতিত। যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। প্রথমবার সংরক্ষিত আসনে, পরে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে দুইবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। শিল্পী হিসেবে তিনি যে সুনাম-সম্মান কুড়িয়েছিলেন, রাজনীতিতে এসে তা খুইয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার পর মমতাজের বোলচালে যে পরিবর্তন এসেছিল, তা ছিল শ্রুতিকটু ও চরম অমার্জনীয়। দলীয় নেত্রীকে খুশি করতে সংসদীয় রীতি উপেক্ষা করে সংসদ অধিবেশনে গলা ছেড়ে স্তুতিমূলক গান গেয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। এর দ্বারা তিনি শুধু বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের কাছে নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও ‘বিরক্তিকর মহিলা’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। আজ তিনি গরাদের অন্তরালে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে। দুদক তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। তদন্ত এবং বিচার শেষ হতে হতে তাঁর শিল্পী-জীবনের পরিণতি কী হবে তা একমাত্র ভবিতব্যই জানে। মমতাজ যদি রাজনীতির মঞ্চে না এসে গানের মঞ্চেই থাকতেন, তাহলে আজকে তাঁর এ পরিণতি হতো না।
শহীদ শহিদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার তাঁর অভিনয়গুণে জয় করেছিলেন সব শ্রেণির দর্শকের মন। তিনিও এখন নিন্দিত। আর নিন্দার এ মণিহার তিনি গলায় পরেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে। একসময় বাংলাদেশের টিভি নাটকে সুবর্ণা মুস্তাফার ছিল জয়জয়কার। তিনিও রাজনীতিতে এসে সে জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদকে হিমাঙ্কের দিকে নামিয়েছেন। চিত্রনায়ক ফেরদৌসেরও একই দশা হয়েছে। কয়েক দিন আগে নগরবাউল জেমস বলেছেন, শিল্পীদের দলীয় রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়। একই কথা বলেছেন নায়করাজ রাজ্জাকের ছেলে বাপ্পারাজও। তাঁদের কথার সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কেননা রাজনৈতিক পরিচয়হীন শিল্পীদের যে সর্বজনীন জনপ্রিয়তা থাকে, দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা দুই ভাগ হয়ে যায়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে কেউ যদি রাজনীতিতে আসেন তা কি অপরাধ? না, অপরাধ নয়। তা ছাড়া রাজনীতি করার অধিকারও রয়েছে তাঁদের। তবে আমাদের মতো দেশে এত বড় ঝুঁকি না নেওয়াই উচিত। এখানে রাজনৈতিক কারণে শিল্পীরা বঞ্চিত হন, কখনো কখনো হন লাঞ্ছিতও। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপির সদস্য বা সমর্থক পরিচিতি আছে, এমন শিল্পীদের নানাভাবে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত করা হয়েছে। স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপাকে বিটিভির কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। অলিখিতভাবে তাঁকে কালোতালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছিল। কোকিলকণ্ঠী বলে খ্যাত শিল্পী বেবী নাজনীনকে থাকতে হয়েছে দূরদেশে। অবশ্য শিল্পীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সাফল্য অর্জনের নজির রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি ছিলেন হলিউডের শক্তিমান অভিনেতা। দুই মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে তিনি সাফল্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের গভর্নর শোয়ার্জনেগারও একজন অভিনেতা ছিলেন। তাঁর অভিনীত ‘টার্মিনেটর-২’ সিনেমাটি ঢাকায়ও প্রদর্শিত হয়েছিল। পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেট তারকা ইমরান খান রাজনীতিতে এসে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছিলেন। হয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতির কুটচালে পড়ে মামলায় জড়িয়ে তিনি এখন কারাবাসী। প্রতিবেশী ভারতে চলচ্চিত্র তারকাদেরও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রবণতা রয়েছে বেশ। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করতেও সক্ষম হয়েছেন। ভারতীয় তেলেগু সিনেমার শক্তিমান অভিনেতা এনটি রামা রাও রাজনীতিতে এসেছিলেন তেলেগু দেশম পার্টিতে যোগ দিয়ে। অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জয়ললিতা জয়রাম। তিনিও তামিল সিনেমার একসময়ের সাড়াজাগানো অভিনেত্রী ছিলেন। মুম্বাই সিনেমার কিংবদন্তি নায়ক অমিতাভ বচ্চনের ছিল গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক। সে সুবাদে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। একবার লোকসভার সদস্যও হয়েছিলেন। তারপর গুডবাই জানিয়েছেন রাজনীতিকে। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পরিচালকের নির্দেশনায় পর্দার ভিলেনকে ঢিসু ঢিসু দিয়ে কুপোকাত করা যত সহজ, রাজনীতির ভিলেনদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তত কঠিন।
বলতে পারেন, ভিন্ন পেশার ব্যক্তিরা জনসেবার জন্য কি রাজনীতিতে আসতে পারেন না? জনসেবার কথাই যদি বলেন, তাহলে সেজন্য আরও বহু পথ রয়েছে। কেউ জনগণের সেবা করতে চাইলে রাজনীতি না করেও তা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, একটু নামডাক বা টাকাপয়সা হলেই অনেকে রাজনীতিতে নেমে পড়েন। কখনো কখনো তারা এতটাই নেমে যান যে, আর উঠতে পারেন না। রাজনীতির রয়েছে একটি অসাধারণ আকর্ষণ-ক্ষমতা। সে দুর্নিবার আকর্ষণ উপেক্ষা করার ক্ষমতা অনেকেরই থাকে না। সে আকর্ষণের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেউ কেউ জীবনের সব অর্জনকে বিসর্জন দেন। সব হারিয়ে হয়তো তাদের চৈতন্যোদয় হয়। তবে তখন আর ফিরে আসার পথ থাকে না।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক