বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের দৃশ্যপটে একটি পরিচিত চিত্র হলো, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামি তার দুই হাত একত্র করে মাথা নিচু করে যেন মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে রয়েছেন। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা বিচারকের অনুকম্পা পাওয়ার আকুতি। এই ভঙ্গি যেন একধরনের সামাজিক নাট্যরীতি হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভঙ্গি কি কোনো আইন, বিধিমালা কিংবা আদালতের রুল দ্বারা নির্ধারিত?
আইনের কোথাও এই ভঙ্গির কথা উল্লেখ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল তিনটি আইন; প্রথমটি হলো পেনাল কোড ১৮৬০, দ্বিতীয়টি হলো ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড ১৮৯৮ এবং তৃতীয়টি হলো সাক্ষ্য আইন ১৮৭২। এর কোনোটিতেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড় করে দাঁড়ানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ২৪২ ও ৩৪২ ধারায় বলা আছে, অভিযোগ পাঠ ও আসামির জবানবন্দির বিষয়ে। সেখানে কাঠগড়ায় আসামির দেহভঙ্গি কেমন হবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। কাঠগড়ায় আসামিকে রাখা হয় মূলত সাক্ষ্য গ্রহণ, শনাক্তকরণ এবং অভিযোগ পাঠের সুবিধার্থে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাত জোড় করা ভঙ্গি মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আদালত সংস্কৃতি থেকে আগত। ব্রিটিশ শাসনামলে আদালতকে একধরনের ‘ভীতিপ্রদ এবং পূজনীয়’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে আমাদের আদালতগুলোর প্রাত্যহিক এই দৃশ্যে।
বিচারকরা সাধারণত আসামিকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মৌখিক নির্দেশ দিলেও হাত জোড় করে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক নয়। বরং অনেক সময় এটা আসামি বা তার আইনজীবীর নিজস্ব সিদ্ধান্তের অংশ, একধরনের নরম মনোভাব ও অনুশোচনার প্রতীক হিসেবে ধরা পড়ে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রুলস, বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট ম্যানুয়াল বা আদালতের আচরণবিধিতেও কাঠগড়ায় আসামির অবস্থানের দেহভঙ্গি সম্পর্কে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। আইনজীবীদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ড্রেস কোড বা কোর্ট রুম অ্যাটিকেট থাকলেও আসামিদের এ ধরনের আচরণ একান্তই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রথানির্ভর।
এটা কেবল আইন বা আদালতের প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক মানসিকতা এবং আদালতের প্রতি ভীতি-শ্রদ্ধার মিশ্র প্রতিক্রিয়া বলেই মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। একদা ব্রিটিশ রাজকীয় আদালতের আদলে গড়ে ওঠা এই কাঠামোতে জনগণের মধ্যে এখনো একধরনের বিচারের ভয়, অনিশ্চয়তা ও আত্মসমর্পণের মানসিকতা বিরাজমান। সেই ভাবাবেগ থেকেই জন্ম নিয়েছে এই ‘মাফ চাওয়ার ভঙ্গি’র প্রথাগত আচরণ।
সুতরাং বলা যায়, আসামি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দুই হাত একত্র করে থাকবেন এই ধারণা বাংলাদেশের কোনো আইন, বিধি বা রুল দ্বারা নির্ধারিত নয়। এটি কেবল ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার অংশবিশেষ। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের দাবি হওয়া উচিত, এসব ঔপনিবেশিক প্রথাগত আচরণের আইনগত ভিত্তি না থাকার কারণে, এসব নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করে এসব ঔপনিবেশিক দাসপ্রথা আচরণ অতিসত্বর পরিহার করে স্বাধীন দেশের আদালতের নিজস্ব নীতিমালা হালনাগাদ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান