বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান কমপ্লেক্সের পূর্ব পাশলাগোয়া চিত্রা নদীর পাড়ে টিনের ছাউনির নিচে উন্মুক্ত স্থানে রাখা আছে ‘ভাসমান শিশুস্বর্গ’ নামে একটি বজরা। নদীতে ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে ছবি আঁকবে শিশুরা-এই ভাবনা থেকেই বজরাটি তৈরি করেছিলেন সুলতান। ১৯৯২-৯৩ সালে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের ইঞ্জিনচালিত দ্বিতল বজরাটি তৈরি করান সুলতান। বজরাটি নির্মাণে সে সময় ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকা। ব্যয়বহুল ও ব্যতিক্রম ডিজাইনের এই নৌকা তৈরি করতে ৬০০ সিএফটি সুন্দরী কাঠ, সাত মণ পেরেক, পাঁচ মণ লোহার বড় পেরেক লেগেছিল। দোতলা এ নৌকায় শোবার ঘর, খাবার ঘর, ছবি আঁকার ঘর ও স্নানের ঘর থাকবে। একসঙ্গে ৬০০ লোক উঠতে পারবে। এরকম বহু পরিকল্পনা ছিল শিল্পীর মনে। শিল্পীর স্বপ্ন ছিল এই নৌকায় শিশুরা ভেসে ভেসে ছবি আঁকবে, সুন্দরবনে যাবে, অরণ্যের ছবি আঁকবে। জীবজন্তুর ছবি আঁকবে, নদী দেখবে, প্রকৃতি দেখবে, প্রাণভরে ছবি আঁকবে। তাঁর ইচ্ছা ছিল নৌকাটি নির্মাণ শেষ হলে তিনি এতে চড়ে ভারতে যাবেন। সেখানে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করবেন। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সুলতান মারা যাওয়ার আগে মাস দুয়েক এটি চিত্রা নদীতে ভাসে। কিন্তু সুলতান মারা যাওয়ার পর এটি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে চলে যায়। ১৯৯৮ সালের বন্যায় বজরাটি চিত্রা নদীতে ডুবে যায়। নৌবাহিনীর সদস্যরা নদী থেকে সেটি তীরে ওঠান। ২০০০ সালে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে সুলতান কমপ্লেক্সের পূর্ব পাশে ইট-বালু-সিমেন্ট দিয়ে একটি বেদি তৈরি করে তার ওপর বজরাটি রাখা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এটি রাখার বেদি উঁচুকরণ ও ছাউনির চারপাশে লোহার গ্রিল নির্মাণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা কার্যকর হয়নি। সংস্কারের অভাবে সেটি এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বজরাটির গলুইসহ কয়েকটি কাঠে ঘুণপোকা ধরেছে। বৃষ্টির পানি লেগে কয়েকটি কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। বজরাটির তলাও দেবে গেছে। বর্তমানে এটি নড়াইল পৌর শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে সুলতান কমপ্লেক্সের পাশে চিত্রা নদীর পাড়ে টিনের ছাউনির নিচে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা আছে। শিল্পী সুলতান শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। নদীতে ভেসে প্রকৃতির দৃশ্য দেখে তারা ছবি আঁকবে এই চিন্তা থেকে তিনি বজরাটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু শিল্পীর সে স্বপ্নসাধ পূরণ হয়নি। সবার সংশয় ছিল সুলতানের নৌকা কি পানিতে ভাসবে?
শিল্পী সুলতানের জবাব ছিল, ‘আমার নৌকা পানি ডেকে আনবে, সমুদ্রকে কাছে টেনে নেবে, নৌকা ভাসবেই।’ বিশ্বখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী ছিলেন রাজমিস্ত্রি। মায়ের নাম মাজু বিবি। জšে§র অল্প দিনের মধ্যেই মা-হারা হন তিনি। শৈশবে পরিবারের সবাই তাঁকে লাল মিয়া বলে ডাকত। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে রাজমিস্ত্রির কাজে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তাঁর। চিত্রা নদীর তীরে তাঁর শিল্পীমানস গড়ে ওঠে। এই উপমহাদেশের গুটি কয় অসামান্য শিল্পীর মাঝে সবচেয়ে জমকালো ছিলেন সুলতান। নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুরের সহযোগিতায় এই বিস্ময়কর প্রতিভাবান শিল্পী ১৯৩৮ সালে কলকাতায় চলে যান। একাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্যবিশিষ্ট চিত্র সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি তাঁর নতুন নাম রাখলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান। সংক্ষেপে এস এম সুলতান। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের চিত্রকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন। সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সুলতান ১৯৪৩ সালে ‘খোকসার’ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে মিসেস হাডসন নামে কানাডীয় এক মহিলার উদ্যোগে ভারতের শিমলায় প্রদর্শিত হলো তাঁর একক চিত্র। এই প্রদর্শনীই তাঁর শিল্পী জীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে তাঁর মোট বিশটি একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এস এম সুলতান। তাঁর জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় তাঁকে শায়িত করা হয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী