শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠদানের মুনশিয়ানায়, মেধার দীপ্তিতে, সদাচরণে, উদারনৈতিক ভাবনায় সুপ্রিয় শিক্ষক হতে পারা কম কৃতিত্ব নয়! আবার তেমন শিক্ষক যদি হন একাধারে প্রজ্ঞাপূর্ণ ও ভালো মানুষ, তাহলে তো কথাই নেই। একদম সোনায় সোহাগা। শিক্ষকদের এই সম্মোহনী গুণাবলি থাকলেই তাঁরা হন স্মরণীয় ও বরণীয়। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে কজন শিক্ষক ছাত্রপ্রিয় হয়ে আলোকবর্তিকায় বহুল প্রশংসিত, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ, অধ্যাপক যতীন সরকার, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক সেলিম আল দীন, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমুখ বিশিষ্টজন। এঁদের বাইরেও আরও অনেকে আছেন কিন্তু সবার নাম তাৎক্ষণিকভাবে লিখতে পারলাম না বলে দুঃখিত। মনে পড়ে নিকট অতীতে, বিস্ময়কর নাট্যপ্রতিভা অধ্যাপক সেলিম আল দীন স্যারের জীবনাবসানের অব্যবহিত পরেই তাঁর অগণিত শিক্ষার্থী ভক্ত কেবিনের সামনে, হাসপাতালের করিডরে, জাবির ক্যাম্পাসে যেভাবে ক্রন্দনে মূর্ছা গিয়েছিলেন, তা ছিলো অভূতপূর্ব। শিক্ষকের প্রতি কতটা অকৃত্রিম ভালোবাসা, মমত্বে এমন হৃদয়াবেগের স্রোতে কেঁদে ভাসা যায়! একজন শিক্ষকের এ কি কম অর্জন ও গৌরবের স্বীকৃতি? তার-ই যেন প্রতিচ্ছবি দেখছি, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর বিকালে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের মৃত্যুর পরক্ষণেই এবং এর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর আরোগ্য কামনায় অগণিত ভক্তকুল শিক্ষার্থীর আকুতিভরা প্রার্থনা এবং হাহাকার ধ্বনি। তাতে প্রমাণিত হয়, মনজুর স্যার সবার কাছে কতটা আদৃত শিক্ষক ছিলেন। জীবনে এবং মরণে এমন সৌভাগ্য কজনের ক্ষেত্রে ঘটে! শোকের আবহ ছড়িয়ে আছে অন্তর্জালজুড়ে। যেন অতি আপন ঐশ্বর্যবান একজন বিদায় নিলেন যাঁর নিজস্ব ভুবন থেকে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জীবনের শেষ বক্তব্য। সেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ‘আবু খালেদ পাঠান সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫ বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, দেখুন শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, সংস্কৃতির একটা শিক্ষা আছে। দুটি মেলে না। যেসব দেশে দুটি মিলে গেছে, সেসব দেশে উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার সংস্কৃতিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটা আলোকিত করে মানুষকে। আর সংস্কৃতির শিক্ষা হচ্ছে সবাইকে সবার সঙ্গে যুক্ত করা।’
সৈয়দ মুজতবা আলীর বংশধর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন জন্মশহর সিলেট ও ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। পরে ১৯৮১ সালে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন। ঢাবি থেকে অবসরে গিয়ে তিনি কিছুকাল ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এ অধ্যাপনায় ছিলেন। শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি ঈর্ষণীয় বৈদগ্ধ অর্জন করেছেন যেমন তেমনি কথাসাহিত্যে, প্রবন্ধ-নিবন্ধন ও অনুবাদে, সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর মনস্বিতার পরিচয় স্পষ্ট। নন্দনতত্ত্ব, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রবীন্দ্রনাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্প প্রসঙ্গ, অলস দিনের হাওয়া, কতিপয় প্রবন্ধ, আজগুবি রাত, আধখানা মানুষ, দিনরাত্রিগুলি, তিন পর্বের জীবন, বেলা অবেলার গল্প, প্রেম ও প্রার্থনার গল্প, সুখদুঃখের গল্প ইত্যাদি তাঁর সর্বোত্তম উদাহরণ। প্রেম ও প্রার্থনার গল্প প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পেয়েছে। এর বাইরেও তাঁর গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও শামসুর রাহমানকে নিয়ে। নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লিখেছেন ‘নন্দনতত্ত্ব শিল্প ও জীবনের সম্পর্কগুলো যেভাবে উন্মোচন করে, তেমনি শিল্পের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক, রীতিনীতি ও নির্মাণ উপকরণকে পাঠ করে। এজন্য শিল্পোন্তর্গত ও শিল্পবহির্ভূত অনেক প্রসঙ্গ নন্দনতত্ত্বে ঠাঁই পায়।... নন্দনতত্ত্ব প্রাচীন শাস্ত্র হয়েও চিরকালই প্রাসঙ্গিক। মানুষের হৃদয়ে প্রকাশের সঙ্গে এর যোগ, মানুষের সৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং মানুষের কর্মকাণ্ডেই এর বৈধতা, এসব মিলিয়েই নন্দনতত্ত্ব।’ স্যার, আপনার নন্দনতত্ত্ব বইটা বেশ কবার পড়েছি, আপ্লুত হয়েছি আপনার ভাষাবিন্যাসে, শৈল্পিক সত্তার গভীরতার অনন্য প্রকাশে। বইটি যত্ন করে সেলফে রেখে দিয়েছি। আবারও পাঠে তৃপ্তি পাব বলে। সংবাদপত্রে যেসব লেখা আপনি লিখেছেন, তা হাতের কাছে পেলে পড়তে কার্পণ্য করিনি কখনো। বিভিন্ন সভায় আপনার মার্জিত ভাষায়, শুদ্ধ উচ্চারণে মননশীল বক্তৃতাও শুনেছি। সবকিছু মিলিয়ে একটা সমীহ জাগা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল আপনার প্রতি। কিন্তু আপনার সান্নিধ্যে খুব একটা যেতে পারিনি বলে খেদ রয়ে গেল! ওপারে নিভৃত বাসে আপনার লেখার মতোই ঝকঝকে তকতকে থাকুন। শোকগ্রস্ত শ্রদ্ধা।
লেখক : সাংবাদিক