বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় যে সংকটটি সবচেয়ে গভীর ও বিপজ্জনক রূপে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। চারদিকে যত বিদ্যা, তত্ত্ব, তথ্য ও কথাবার্তার সমারোহ দেখা যায়, তার ভিতর অন্তঃসারশূন্যতাই প্রকট। চায়ের দোকানের টঙ-আলাপ থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শো পর্যন্ত হাজারো কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ নানা বিশ্লেষণ ও পরামর্শে মাতিয়ে রাখলেও, তাদের নৈতিক দৃঢ়তা বা সমাজ-নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এরা যেন পেছন থেকে পাহাড় ঠেলার চেষ্টায় ব্যস্ত, কিন্তু সামনে আলোর পথ দেখানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণে। চারদিকে উচ্চ ডিগ্রির সনদের ছড়াছড়ি। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এক মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরে : আমরা কি সত্যিই শিক্ষিত মানুষ হতে পেরেছি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ‘শিক্ষা’ ধারণার পর্যালোচনা প্রয়োজন। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, একজন সৎ, দায়িত্বশীল ও মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি জোরালো। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাছে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। জাপানি শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন, শিষ্টাচার, দায়িত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা প্রাথমিক স্তরেই শেখে সহানুভূতি, পরিচ্ছন্নতা, দায়িত্ববোধ, দলগত কাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতির মূল্য। তাদের এই মানবিক ভিত্তির নির্মাণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশের জন্য গভীরভাবে শিক্ষণীয়, বিশেষত যখন আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় একপ্রকার প্রাত্যহিক চিত্রে পরিণত হয়েছে।
প্রাথমিক স্তরেই শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতার হাতেখড়ি হওয়া উচিত প্রতিটি শিশুর। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশ ও বিদ্যালয়-পরিবার সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার এক অনন্য দিক হলো শিশুদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, যা শুরু হয় জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক স্তর থেকেই। জাপানে শ্রদ্ধা কেবল সামাজিক শিষ্টাচার নয়, বরং শিক্ষার একটি অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, যা শিক্ষার্থীদের আচরণে প্রাত্যহিকভাবে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহপাঠীদের প্রতি সৌজন্য প্রকাশ এসব শুধু পাঠ্যসূচির অংশ নয়, বরং জীবনের অপরিহার্য অনুশীলন হিসেবে আত্মস্থ করা হয়। বিশেষ করে মেইজি যুগের পর থেকে জাপানে এই চর্চার ভিত গড়ে ওঠে কনফুসীয় নীতির ভিত্তিতে, যেখানে সামাজিক সাম্য, আনুগত্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা ও কর্তব্যবোধকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হয়।
জাপানি স্কুলে শিশুরা নিজেরাই শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করে, টয়লেট ঝাড়ু দেয়, এমনকি খাবার পরিবেশনেও অংশ নেয়। এতেই গড়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত ভিত। ‘নিজের কাজ নিজে করা’ সেখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নয়, বরং মর্যাদার বিষয়, একটি সংস্কৃতিগত অবস্থান। এ ধরনের শিক্ষা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নাগরিক গুণ (ভার্চু) গঠনের তত্ত্বের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যেখানে মানবিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ব্যক্তির অভ্যাস, অনুশীলন ও নৈতিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়।
জাপানে খাবারের সময়টিও শিক্ষার অংশ। একত্রে বসে খাওয়া, নিজের খাবার নিজে নেওয়া ও অন্যকে খাবার পরিবেশন করা এবং অংশীদারত্বের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে তোলা- এসবই শেখায় বিনয়, সমতা ও সামাজিক সংহতি। এ প্রক্রিয়ায় শিশুরা শিখে, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা মানবিক সমাজের ভিত্তি। একজন পিছিয়ে পড়লে তাকে টেনে তোলা, অন্যের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো এবং সম্মিলিতভাবে সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়াই সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘মানবিকতা’র প্রকৃত অর্থ। এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রমাণ করে, নৈতিকতা ও মানবিকতা কোনো পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমে এগুলো ব্যক্তি ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে পারে।
জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনুকরণীয় দিকগুলোর একটি হলো- নৈতিক শিক্ষাকে (মোরাল এডুকেশন) পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। ‘ডোতোকু’ (নৈতিকতা বা নীতিশাস্ত্র) নামে পরিচিত এই পাঠ্যক্রমে শিশুদের নৈতিকতা ও মানবিকতার বিষয়গুলো শেখানো হয় গল্প, নাটক, জীবনের বাস্তব ঘটনা এবং দৃশ্যচিত্রের মাধ্যমে। এর কারণ ডোতোকু একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যা জাপানি সংস্কৃতি এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারণা প্রকাশ করে। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে এর সংযোজনের উদ্দেশ্য নিছক আচরণগত সংশোধন নয়; বরং শিক্ষার্থীর মাঝে একটি সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ মানবিক চরিত্র গঠন।
জাপানের এই শিক্ষানীতি ইমানুয়েল কান্টের নীতিবাদী দর্শনের সঙ্গে মিল রয়েছে, যেখানে মানুষকে উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা হয়, উপায় হিসেবে নয়। শিশুকে শেখানো হয় সততা মানে শুধু মিথ্যা না বলা নয়, বরং আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সত্যে অবিচল থাকা। সহানুভূতির মানে কেবল দয়া নয়, বরং অপরের অবস্থান বোঝার সক্ষমতা ও সক্রিয় সহায়তা। দায়িত্ববোধ মানে নির্ধারিত কাজ শেষ করা নয়, বরং সমাজ ও পৃথিবীর প্রতি এক অন্তর্নিহিত দায়বদ্ধতা অনুভব করা। এই পাঠ্যসূচিতে শিশুদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হলো একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। তারা শিখে, সামাজিক দায়দায়িত্ব ও মর্যাদা, চাকরি বা সম্পদের চেয়ে মূল্যবান হলো চরিত্র, আত্মসম্মানবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তা। এই দৃষ্টিভঙ্গি জাপানের সামাজিক কাঠামোতে গভীরভাবে প্রোথিত, এবং এর ফলে গড়ে ওঠে একটি দায়িত্বশীল, সহযোগিতামূলক ও মানবিক সমাজ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে যেখানে বর্তমানে নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে কিংবা সেটা শিক্ষায় ও আচরণে প্রায় অনুপস্থিত; কিংবা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে জাপানের এই মডেল আমাদের জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই হলো নৈতিক শিক্ষার পরিণত রূপ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার এটি আরেকটি ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর দিক। শিশুদের জীবনের শুরুতেই শিখানো হয় ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে। এটি শুধু ভদ্রতা বা সামাজিক শিষ্টাচারের অংশ নয়, বরং নৈতিকতার একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা বুঝে নেয়, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নিজস্ব পরিসর বা পরিমণ্ডল আছে, যাকে সম্মান জানানো মানে তার মর্যাদাকে স্বীকার করা। তাদের শেখানো হয় কাউকে তার পারিবারিক, আর্থিক, শারীরিক অবস্থা কিংবা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা অনুচিত। কারও ওজন, বয়স কিংবা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কৌতূহল প্রদর্শন করা সেখানে শুধু অশোভন নয়, এটি সামাজিক সচেতনতার ঘাটতির লক্ষণ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এই আচরণগত অনুশাসন মূলত ‘সহানুভূতিশীল সংবেদনশীলতা’ গঠনের মাধ্যমে শিশুদের ভিন্নতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করতে শেখানো হয়।
আমাদের সামাজিক পরিসরে প্রায়ই দেখা যায়, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত কৌতূহল ও মন্তব্য সামাজিক অসৌজন্যতাকে উৎসাহ দেয়, যা অনেক সময় মানসিক অবক্ষয় ও বৈষম্যের জন্ম দেয়। জাপানের শিক্ষার সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়ে দেয়, সংবেদনশীলতা, সম্মান ও সহানুভূতির চর্চা কেবল আচরণের নয়, বরং নৈতিক উন্নয়নের পরিণত প্রকাশ।
অপরদিকে অন্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে ‘না’ বলার অধিকার এবং পছন্দ ও অপছন্দ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিরুচির সম্মানজনক চর্চাই জাপানি শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদাবোধের বিশেষ পাঠ। জাপানি নৈতিক শিক্ষার একটি মৌলিক দিক হলো, শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় ‘না’ বলার অধিকার সবার আছে, এবং অন্যের সেই ‘না’ বলাকে শ্রদ্ধা করা অপরিহার্য। এটি কোনো বিদ্রোহী মানসিকতা নয়, বরং নিজস্ব ব্যক্তিত্বের সীমারেখা বা পরিসর (পারসোনাল বাউন্ডারিজ) নির্ধারণ ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশের প্রাথমিক ধাপ। জাপানি সমাজে একে অপমান নয়, বরং পারস্পরিক সম্মানের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা বুঝে যায়, মানবিক সম্পর্ক জোরজবরদস্তির নয়, পারস্পরিক সম্মতি ও বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠা উচিত। ফলে জাপানে কারও ওপর নিজের মত, অনুভব বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি অনুপস্থিত। ‘আমি এটি করতে চাই না’- এই বাক্যটি সেখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়ের চিহ্ন, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদাকে নিশ্চিত করে। শিশুরা সহজেই শিখে নেয় অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া, তার অভিপ্রায় শুনে নেওয়া এবং তার গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা; আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলোই একটি সুস্থ ও ন্যায্য সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য