‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’র এই শহরে রিকশা ছাড়া যাতায়াতের কথা ভাবাই যায় না। স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দী পার হলেও আমরা গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে স্বল্প বা মাঝারি দূরত্বে রাজধানীবাসীর চলাচলের একমাত্র বাহন রিকশা। রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে মিরপুর, পল্লবী, শেওড়াপাড়া, ভাসানটেক, আগারগাঁও, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, জিগাতলা, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, খিলক্ষেত, নিকেতন, মহাখালী, মালিবাগ, শান্তিনগর, মতিঝিল, বাড্ডা, বনশ্রী, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মান্ডা, মাদারটেক, সিপাহিবাগ, সবুজবাগ, বাসাবো এলাকার লাখ লাখ সাধারণ জনগণের স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য কোনো গণপরিবহন নেই। তাই এসব এলাকার অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় চলাচল করে থাকেন। যদিও এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা নিরাপত্তার ন্যূনতম মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্রেকিং সিস্টেম দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীতে জ্যামিতিক হারে যান্ত্রিক রিকশা বৃদ্ধির কারণে স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে যানজটের সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে। যানজটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক অবসাদ। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। গণপরিবহনব্যবস্থা মানসম্মত না হওয়ায় মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশার মতো ছোট যানবাহন প্রধান পরিবহনে পরিণত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন এলাকায় প্রায় ৫২ হাজার আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় প্রায় ২৮ হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশা চলাচল করে। তার মানে সরকারিভাবে অনুমোদিত মোট রিকশার সংখ্যা ৮০ হাজারে পৌঁছেছে। কিন্তু নগর পরিবহন বিশ্লেষকদের মতে, দুই সিটি করপোরেশনে ৫ থেকে ১০ লাখ রিকশা চালু রয়েছে, যার মধ্যে আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই অনিবন্ধিত অথবা ডুপ্লিকেট লাইসেন্স প্লেট বানিয়ে চলছে। অপরদিকে অটোরিকশা সংগঠনের নেতাদের হিসাবে, রাজধানীর ৫০টি থানার আওতায় এখন প্রায় পাঁচ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এই পরিসংখ্যান পুরোনো প্যাডেল রিকশার সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আশঙ্কার কথা হলো, এসব রিকশার অনেক চালকেরই মোটরচালিত যান চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তাদের বেপরোয়া গতির কারণে ছোটবড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্যাটারি রিকশা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে সক্ষম। এই গতি সরু রাস্তায় সহজেই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তিন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে ব্যাটারিচালিত ই-রিকশা। প্রাথমিকভাবে উত্তরা, ধানমন্ডি ও পল্টনে চালু হবে ই-রিকশা। তবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকাতেও এই যানবাহন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ২৮ জুন ২০২৫ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, বর্তমানে চলমান রিকশাগুলো এখনই উঠিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নেই। সেগুলোর পাশাপাশি নতুন ই-রিকশা চলবে এবং ধাপে ধাপে পুরোনো রিকশা কমিয়ে আনা হবে। ইতোমধ্যে তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার স্ট্যান্ডার্ড মডেল ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুমোদিত হয়েছে। অপরদিকে আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় যানজট ও অতিরিক্ত রিকশাভাড়া কমাতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা মিনিবাস ইতোমধ্যেই নগরবাসীর নজর কেড়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়ও যানজট নিরসনে শাটল বাস চালু হয়েছে। বিদ্যুৎচালিত হওয়ার কারণে এই বাসগুলো শব্দ ও ধোঁয়াবিহীন। সর্বনিম্ন ভাড়া মাত্র ১০ টাকা হওয়ায় এটি সাশ্রয়ী। পরিবেশবান্ধব এই বাসগুলো ৩০০ ফিট প্রবেশপথ থেকে শুরু করে এভারকেয়ার হাসপাতালের পকেট গেট পর্যন্ত চলাচল করছে। এই শাটল বাসগুলো একসঙ্গে ১০ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারে। ঢাকার আবাসিক এলাকায় বৈদ্যুতিক শাটল বাসের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর সব আবাসিক এলাকাসহ স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বে চলাচলের জন্য এই শাটল বাস চালু করা গেলে যানজট হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি যাতায়াত খাতে সাধারণ জনগণ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট