বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যা সময়ের দেয়াল পেরিয়েও প্রজন্মের মনে থেকে যায়। ‘ছুটির ঘণ্টা’ সেই তালিকার একেবারে শুরুর দিকে। আশির দশকের সেই চলচ্চিত্র কেবল একটি ছেলের গল্প নয়, এ এক সমাজের বিবেক জাগানো ইতিহাস। ১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ‘ছুটির ঘণ্টা’। মুক্তির ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সিনেমাপ্রেমীদের স্মৃতির মণিকোঠায় এই সিনেমার গল্প, চরিত্র, আবেগ আজও প্রবহমান।
ঘণ্টার শব্দে শুরু এক অমর চলচ্চিত্র
ছবির সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি তালাবদ্ধ বাথরুমে এক শিশুর নিঃশব্দ যন্ত্রণা। স্কুলের বাথরুমে সবার অগোচরে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে ১২ বছরের এক ছাত্র। শুরু হয় তার নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন, যেখানে প্রতিটি দিন ছিল ভয়, ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। দীর্ঘ ১১ দিনের ছুটির অপেক্ষা যেন পরিণত হয় মৃত্যুর প্রহরে। দেয়ালের ওপর শিশুটি লিখে যায় তার ভয়, ব্যথা আর অসহায় অনুভবের কথা। ঈদের ছুটি শেষে যখন স্কুলের গেটে বাজে ‘ছুটির ঘণ্টা’, তখনই ফাঁস হয় সেই মর্মান্তিক ঘটনার পরিসমাপ্তি, বাথরুম থেকে উদ্ধার হয় ছেলেটির নিথর দেহ। আর সেই ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে দপ্তরি আব্বাস মিয়া স্বেচ্ছায় জেলে যান।
সংবাদ থেকে জন্ম নেয় মহাকাব্যিক গল্প
নির্মাতা আজিজুর রহমান ছুটির ঘণ্টার স্মৃতি রোমন্থন করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলার বাণী পত্রিকায় চোখ রাখতেই দেখতে পাই একটি ছোট্ট সংবাদ, ‘নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলছাত্র ছুটির আগে বাথরুমে আটকে মারা গেছে।’ খবরটি পড়ার পর মন খারাপ হয়ে গেল। সেখান থেকেই শুরু হয় ‘ছুটির ঘণ্টা’র যাত্রা। কিন্তু কেউ প্রযোজনা করতে চায়নি। কারণ? নায়িকা নেই, প্রেম নেই, বাণিজ্য নেই। তখনকার প্রযোজকদের কাছে এই গল্প ‘অ-সিনেমাটিক’। কিন্তু আমার কাছে এটি ছিল এক মানবিক প্রতিবাদের কাহিনি। নিরুপায় হয়ে সত্যদাকে ধরলাম। বোঝালাম, ‘অশিক্ষিত’ ছবিতে তো তিন-চার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। এ ছবির জন্য পাঁচ-সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করুন। একটা রিস্ক নিন। আমার আগ্রহ দেখে তিনি রাজি হলেন।’
নায়িকা এলেন সুইপারের ঘর থেকে
শুটিং হয়েছিল কাপ্তাই এলাকায়। রাজ্জাক অভিনয় করেন ঘণ্টাবাদক (দপ্তরি) আব্বাস মিয়ার চরিত্রে। কিন্তু পরিচালক চিন্তায় পড়লেন, ‘নায়িকা কোথায়?’ এক দিন কাকরাইলের অফিসে প্রবেশ করতেই আজিজুর রহমান দেখেন, এক নারী টেবিলের ওপর বসে সিগারেট টানছে। সেই দৃশ্যই জন্ম দেয় নায়িকার চরিত্রের ধারণা, স্কুলের ঝাড়ুদারনি! আর সেই ভূমিকায় অভিনয় করেন শাবানা। চরিত্রটি বাস্তব করার জন্য রাজ্জাক-শাবানা মিলে ধোলাইখালের সুইপারপট্টিতে গিয়েছিলেন, দেখেছিলেন তাঁদের জীবনযাপন।
মুক্তির পর নানা ঘটন-অঘটন
ছবিটি সেন্সর বোর্ড আটকে দিল। কারণ এ ছবিটি কোমলমতি শিশুদের ওপর বাজে প্রভাব পড়বে। তবে আজিজুর রহমান বুদ্ধি বের করে ছবির একটা বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ছবি শেষে দেখা গেল, শিশুরা ভয় তো পেলই না, উল্টো চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বের হচ্ছে। এরপর ১৯৮০ সালে ‘ছুটির ঘণ্টা’ মুক্তি দেওয়া হলো। মাত্র ২০টি হলে মুক্তি পায় ‘ছুটির ঘণ্টা’। এরপর সারা দেশে কোথাও চার-পাঁচ সপ্তাহ, কোথাও এক-দুই থেকে পাঁচ মাসও ছবিটি চলেছে। অনেক ঘটনা ঘটে ছবি মুক্তির পর। দিনাজপুরের মডার্ন হলে ম্যাটিনি শোতে এক মহিলা ছবি দেখতে দেখতে আবেগে কোলের শিশুসন্তানকেই চাপ দিয়ে মেরে ফেলেছেন! এক শোতে ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখতে আসা হলের সব দর্শকই ছিলেন নারী।’
কোথায় সেই ‘খোকা’ সুমন সাহা
যে ছেলেটি বাথরুমে বন্দি হয়ে আমাদের কাঁদিয়েছিল, সেই শিশুশিল্পী সুমন সাহা বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। পেশায় অরল্যান্ডো বিমানবন্দরের কর্মকর্তা, পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসায়ী। স্ত্রী শুভ্রা ও দুই মেয়ে, শ্রেয়সী ও সঙ্গিনী সাহাকে নিয়ে তাঁর সংসার। ভাই ইমন সাহা, সংগীতজীবন নিয়ে সময় পার করছেন। বাবা সত্য সাহা ১৯৯৯ সালে মারা যান।