ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র এখন বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন প্রযুক্তিগত পরীক্ষার ময়দান। একসময় পশ্চিমা সামরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত অত্যাধুনিক ড্রোনগুলোই আজ এই রণাঙ্গনে ব্যর্থতার মুখে। সামরিক প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এই নতুন বাস্তবতা।
ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অপরিহার্য অস্ত্র ছিল সুইচব্লেড-৩০০-এর মতো দ্রুতগতির নির্ভুল ড্রোনগুলো। কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখার পরই পাল্টে যায় চিত্র। এই ব্যয়বহুল ড্রোনগুলো রাশিয়ার শক্তিশালী ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থার মুখে হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অকার্যকর।
বোরোভিক ইউক্রেনীয় ড্রোন নির্মাতা ভ্যালেরি বলেন,
আমরা যখন এগুলো পরীক্ষা করেছিলাম, জ্যামিং অবস্থায় এগুলো একদমই কাজ করেনি। এমনকি একটি মিনিবাসের পেছনের জানালায় আঘাত করার পরও সামনের কাচও ভাঙেনি।
ইউক্রেনীয়দের মতে, পশ্চিমা প্রযুক্তির এই ব্যর্থতার মূল কারণ 'দর্শনের সংঘাত'। পশ্চিমা দেশগুলো এতদিন মনোযোগ দিয়েছিল সীমিত যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য উচ্চমানের প্রযুক্তির ওপর। যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল দুর্বল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ হলো এক সর্বাত্মক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রযুক্তিগতভাবে 'গণতান্ত্রিক' যুদ্ধ।
এই যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের গড় আয়ু অত্যন্ত সীমিত, কখনও কখনও একটি স্থলচর ড্রোনের আয়ু মাত্র এক সপ্তাহ! এমন বাস্তবতায় কয়েক লাখ ডলারের পশ্চিমা সিস্টেম পাঠানোর যৌক্তিকতা নেই। যেখানে ইউক্রেনীয় কোম্পানিগুলো মাত্র ১০ থেকে ২০ হাজার ডলারে একই কাজ করতে পারে এমন ড্রোন তৈরি করছে।
ব্রেভ-১ কর্মকর্তা এদুয়ার্ড লিসেঙ্কো বলেন, এটা ঠিক যেন সবাইকে গাড়ি দেওয়ার জন্য আপনি বিএমডব্লিউ বেছে নিচ্ছেন, তুলনামূলক কম দামের স্কোডা অক্টাভিয়াস নয়।
ইউক্রেন এখন মনোযোগ দিচ্ছে 'সস্তা ও ব্যাপক' উৎপাদননির্ভর প্রযুক্তির ওপর। রাশিয়ার মলনিয়া ড্রোনের রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করা ব্লিসকাভকা ড্রোন তারই প্রতীক। মাত্র ৮০০ ডলারে তৈরি এই ড্রোনটি ৮ কেজি বিস্ফোরক ৪০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বহন করতে সক্ষম। ইউক্রেনীয় নির্মাতারা বলছেন, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো এখনো অতিরিক্ত নকশা ও অত্যধিক ব্যয়ের চক্রে আটকে আছে।
বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে মাত্র ২০-৩০% পশ্চিমা। ইউক্রেনীয় কোম্পানিগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, দ্রুত এবং নমনীয় পণ্য তৈরি করে এখন ড্রোন প্রযুক্তিতে প্রায় বিশ্বের সব দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে।
যদিও জার্মানির কোয়ান্টাম সিস্টেমস-এর মতো কিছু পশ্চিমা কোম্পানি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছে। তবে ইউক্রেনের এই উদ্ভাবন এখনো আন্তর্জাতিক অর্থ প্রবাহের কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি। ন্যাটো দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের বেশিরভাগই এখনো ইউরোপীয় প্রযুক্তিতে যাচ্ছে। যা রাশিয়ার যুদ্ধ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে ইউক্রেনের বহু পরীক্ষিত কোম্পানি অর্থাভাবে তাদের ৪০ শতাংশ ড্রোন উৎপাদন ক্ষমতা অলস ফেলে রেখেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে ভবিষ্যতের যুদ্ধে সস্তা ও ব্যাপক উৎপাদননির্ভর প্রযুক্তিই মুখ্য উপাদান হতে যাচ্ছে। ভ্যালেরি বোরোভিক ইউক্রেনীয় ড্রোন নির্মাতা, তার মতে, আমার পরামর্শ, যদি আপনি আজ ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত না থাকেন, তবে আগামীকাল (প্রতিরক্ষায়) দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছেন।'
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র পশ্চিমা প্রতিরক্ষা নীতিতে এক গভীর পরিবর্তন আনছে, যা সামরিক প্রযুক্তির ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনোমিস্ট
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল