১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্যোদয়ের কথা কারোর পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়! ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্রোত, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, ১ কোটি মানুষের উদ্বাস্তু জীবন, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ১ কোটিরও বেশি ঘরবাড়ি-এ ভয়ংকর ঘটনাবলির বিনিময়েই অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন এক লাল-সবুজ পতাকা স্থান করে নিয়েছিল, যার প্রতিটি ভাঁজে লেখা ছিল অসীম ত্যাগ আর আশার গল্প। এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্র, সাম্য ও উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠার জন্য। স্বপ্ন ছিল একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ; যেখানে থাকবে না শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতি, দুঃশাসন। যেখানে প্রতিটি মানুষ তার যোগ্যতা, মেধা ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবে। এমন এক সমাজ যেখানে ‘পুলিশের কাছে ঘুষ না দিয়ে’, ‘বিচারকের কাছে তদবির না করে’, ‘চাকরি পেতে ঘরবাড়ি বিক্রি না করে’ মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়েও সেই স্বপ্ন আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রত্যাশা ও অর্জনের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। আমাদের সমসাময়িক দেশগুলোর দিকে তাকালে বুকে হাহাকার জাগে। ১৯৭১ সালে যাদের মাথার ওপর বোমা পড়েছিল, সেই ভিয়েতনাম আজ বৈশ্বিক পণ্য উৎপাদনে অন্যতম শক্তি। দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উঠে এসে প্রযুক্তির মহাসিংহাসনে বসেছে রাজকীয় মর্যাদায়। সিঙ্গাপুর একসময় ছিল কাদামাটির দ্বীপ, আজ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ বন্দরনগরী।
আর আমরা? আমরা আজও ঘুরপাক খাচ্ছি ন্যূনতম নাগরিক সেবা, মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষ কর্মসংস্থান, নিরাপদ খাদ্য ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মতো মৌলিক চাহিদার বৃত্তে। যার মূল কারণ আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলা শ্রেণির এক অন্তহীন দুষ্টচক্র। স্বাধীনতার পর জনগণ ভেবেছিল রাজনীতিবিদরা হবেন জাতির পথপ্রদর্শক আর আমলারা হবেন সেই পথচলার দক্ষ কারিগর। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার মোহে জনগণকে ভুলে গেছেন, আর আমলারা হয়েছেন সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকদের সহযোগী। ক্ষমতার মসনদে বসে তারা কাগজকলমে উন্নয়নের মহাসড়ক দেখিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে নির্মাণ করেছেন দুর্নীতির সুড়ঙ্গ। তাতে দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। জনমনে বেড়েছে হতাশা। উদাহরণ কি দরকার? গেল কয়েক বছরে যে পরিমাণ ব্যয়বহুল প্রকল্পের ঘোষণা এসেছে, তার অধিকাংশই প্রশ্নবিদ্ধ। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকায়। সেই প্রকল্পে ধরা পড়েছে ভুয়া বিল, কম দামি মালামাল বেশি দামে ক্রয়, অযোগ্য ঠিকাদারের হাতে কাজ তুলে দেওয়াসহ আরও অনেক অসংগতি। এমনকি হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্টের বদলে পাওয়া গেছে ভাঙা পাইপ। দেশের দুঃখ বর্ণনা করতে কি এর চেয়ে করুণ উদাহরণ দরকার?
দুঃখের বিষয় হলো, এসব অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। কোনো আমলা, কোনো প্রকৌশলী, কোনো মন্ত্রী জবাবদিহির মুখোমুখি হননি। বরং তারা হয়েছেন আরও ক্ষমতাশালী। বিদেশে কোটি কোটি ডলারের ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালান্স, সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনের গল্প আজ ওপেন সিক্রেট। অথচ গ্রামে মরে যাচ্ছে কৃষক ঋণের বোঝায়, শহরের মধ্যবিত্ত হিমশিম খাচ্ছে নিত্যপণ্যের দামে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও একেকজন যেন বন্দি জীবনযাপন করছেন অদৃশ্য বন্দিশালায়।
অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা ছিল এক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার। বাস্তবে দেখা গেল ধর্ম ব্যবসায়ীদের উত্থান, গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনি তামাশা, সমাজতন্ত্রের নামে লুটপাট, জাতীয়তাবাদের নামে উগ্র জাত্যভিমান। এ দায় শুধু রাজনৈতিক নেতাদের নয়, আমলাদেরও। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ ছাড়া নড়চড় না হওয়া ফাইলে আজও লাল দাগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমাদের দপ্তরগুলোতে ‘দালাল’ নামক এক শ্রেণির মানুষের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো আছে। জনগণের সচেতনতা বেড়েছে। আজকাল দুর্নীতির খবর সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়; বিচার চাওয়া মানুষ বাড়ছে; প্রতিবাদ করার সাহসিকতা ফিরে আসছে। তরুণ প্রজন্ম প্রশ্ন করছে-এ দেশ কি ত্যাগের স্বপ্ন পূর্ণ করেছে? আমরা এখনো উন্নতির চূড়ায় পৌঁছাইনি; কিন্তু পৌঁছাতে পারি, যদি রাজনীতির মাঠে আদর্শ ফেরে, আমলাদের কাঁধে নীতি ও সততার বোঝা পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, যদি দেশের মালিক জনগণ নিজের অধিকার নিয়ে সজাগ হয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন একটাই-এ বাংলাদেশ কি শহীদের সেই বাংলাদেশ, নাকি কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে? এ অবস্থার অবসানে দেশের মালিক-মোক্তার যারা, তাদের সচেতন হতে হবে। নিজেরা সচেতন না হলে কেউ তাদের জন্য কিছু করে দিয়ে যাবে না। এটি এ দেশের মানুষের ৫৪ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা। দেশ ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে সর্বস্তরের মানুষকে, বিশেষত যুবসমাজকে। বাংলাদেশের মানুষের হার না মানার ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের ওপর ভরসা রেখে জাগতে হবে ১৮ কোটি মানুষের এ জাতিকে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটি