গত শনিবার ১৬ আগস্ট ছিল জন্মাষ্টমী। এ উপলক্ষে পলাশীর মোড়ে জন্মাষ্টমী উৎসব এবং আনন্দ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তিন বাহিনীর প্রধানরা। তারা প্রদীপ প্রজ্বালন করে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন এবং নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান সম্মিলিতভাবে যে প্রদীপ প্রজ্বালন করেন, এটি যেন সারা বাংলাদেশের এক প্রতীক। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় সশস্ত্র বাহিনী যেন আশার প্রদীপ হয়ে বাংলাদেশকে পথ দেখাচ্ছে। তারা যেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের সাহস এবং স্বস্তির প্রতীক হয়ে আছেন। তাদের কারণেই যেন বাংলাদেশ এখনো পথ হারায়নি। ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। স্বৈরশাসনের পতনের পর বাংলাদেশকে একটি অনিবার্য গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করছে সশস্ত্র বাহিনী। একটি গণতান্ত্রিক পথে রূপান্তরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এক গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে নিরলসভাবে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় জনগণের পক্ষে, জনগণের মঙ্গলে নিবেদিতপ্রাণ এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। গত এক বছরে এটি প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা যদি ২০২৪-এর জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দিকে ফিরে যাই তাহলে দেখব এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর যে পাশবিক বর্বরতা এবং পৈশাচিকতা চালানো হয়েছিল, সেটি প্রতিরোধে প্রথম এগিয়ে আসে সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বস্তরের অফিসার এবং সৈনিকরা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। সশস্ত্র বাহিনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলনকারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করা হবে না, গুলি করা হবে না। তাদের এ সিদ্ধান্তের কারণে আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। স্বৈরাচার পতনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন পায় গতি। এ আন্দোলনের ধারায় শেষ পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন হয়। কাজেই চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী অন্যতম অংশীদার। শুধু অংশীদার নয়, সশস্ত্র বাহিনী এ আন্দোলনের বিজয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান, তখন দেশে একটি সরকারহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কী ধরনের সরকার হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দেয় মতবিরোধ। কেউ জাতীয় সরকারের পক্ষে, কেউ বিপ্লবী সরকারের পক্ষে এরকম নানা মত, নানা পথে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল একটি সাংবিধানিক শূন্যতা এবং অচলাবস্থা। এ সময়ও ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ক্যান্টনমেন্টে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং শিক্ষক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানান। দীর্ঘ বৈঠক করেন এবং একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে সক্ষম হন। সব পক্ষ তার নেতৃত্ব মেনে রাষ্ট্রপতির কাছে যান। রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের জনগণ আশ্বস্ত হয়। দেশ একটি অনিবার্য সাংবিধানিক শূন্যতা থেকে মুক্তি পায়। মূলত সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতা এবং দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিক মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত কোনোরকম সংঘাত ছাড়াই সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠনে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এ সরকারের নেতৃত্বে এক বছর পার হয়েছে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনী পেছনে থেকে নিরলসভাবে সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখছে এবং বাংলাদেশে যেন শান্তি, স্থিতিশীলতা থাকে সেজন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থাকছে। নতুন সরকার একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে তাদের যাত্রা শুরু করে। বিশেষ করে সেই সময় পুলিশ বাহিনী ছাত্র-জনতার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। জুলাই আন্দোলনে কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের ভূমিকার কারণে তাদের ওপর জনরোষ একটি ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সে কারণেই পুলিশ হয়ে পড়েছিল নিষ্ক্রিয়। এ সময় যদি সশস্ত্র বাহিনী না থাকত, দেশে একটি অরাজক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করা, জনগণের জানমাল হেফাজতের দায়িত্ব তুলে নেয় সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীর মাঠের সদস্যরা দিনরাত একাকার করে কঠোর পরিশ্রম করে জনগণের জানমালের হেফাজত করেছেন। এরকমও দেখা যাচ্ছে যে দিনের পর দিন সশস্ত্র বাহিনীর মাঠে কর্মরত সদস্যরা নিদ্রাহীন অবস্থায় থেকে মানুষের জানমালের হেফাজত করেছেন। মানুষ যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে সেজন্য তারা রাতের পর রাত কাজ করে গেছেন। এভাবেই সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে আগলে রেখেছে। দেশের পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক হয় সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করে গেছে।
নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি তৈরি হয় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। যে যার মতো করে আইন হাতে তুলে নিতে শুরু করে। কেউ বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, কেউ মব জাস্টিসের নামে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। এসব ভয়াবহ প্রবণতা কখনোই বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং এ ধরনের ঘটনা বিপ্লবের মূল আকাক্সক্ষা এবং চেতনাকেই নষ্ট করে দেয়। আর এজন্যই সশস্ত্র বাহিনী তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- কোথাও সশস্ত্র বাহিনী এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের নীতি অনুসরণ করেনি। তারা জনগণের পাশে থেকে, জনগণকে বুঝিয়ে, জনগণের সত্যিকারের আপনজন হয়ে তাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়তা করেছে। এটি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে চব্বিশে গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা একটি মডেল হয়ে থাকবে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, ৫ আগস্টের পর ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা ভয়ে ছিলেন, আতঙ্কে ছিলেন। অনেক কলকারখানায় আগুন দেওয়া হয়েছে। অনেকে দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা বন্ধ রেখেছেন। এর ফলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার শঙ্কার সৃষ্টি হয়। এজন্যই সশস্ত্র বাহিনী চুপচাপ বসে থাকেনি, বরং তারা নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছেন। ব্যবসায়ীদের দিয়েছেন নির্ভরতা। তারা যেন ব্যবসাবাণিজ্যে সাহায্য করতে পারে সেজন্য তাদের একদিকে যেমন নিরাপত্তা দিয়েছেন, অন্যদিকে দিয়েছেন সহায়তা। মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যে আবার সচল হয়েছে, ব্যবসায়ীরা যে কিছুটা হলেও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তাদের স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছেন তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো সশস্ত্র বাহিনীর নিরলস পরিশ্রম, অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাদের নিরাপত্তা বিধান এবং ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়ানো।
আমরা জানি যে কোনো দেশে বিপ্লবের পর একটা প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নানারকম নাশকতা এবং অপতৎপরতার মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে। ৫ আগস্টের পর এ ধরনের বহু ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কথায় কথায় আন্দোলন, সচিবালয় ঘেরাও বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংসে নষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা সব সময় ছিল। এটির ফলে একদিকে যেমন জনজীবনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক, অন্যদিকে তেমনি সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সশস্ত্র বাহিনী ছিল মানুষের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল। সশস্ত্র বাহিনী দৃঢ়ভাবে এ ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছে। আনসার বিদ্রোহ কিংবা বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা, হানাহানি দমনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী শান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন করে ধৈর্য এবং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। যার কারণে ৫ আগস্টে বিপ্লবের পর কোনো ষড়যন্ত্রই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বাংলাদেশ তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা দেশে যখন একটি বিপ্লব হয়, তারপর দেশের সার্বভৌমত্ব নানা কারণে ঝুঁকিতে পড়ে। বাংলাদেশ এ সময় এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে আরাকান আর্মির তৎপরতা এবং আরাকান আর্মিকে ঘিরে পার্বত্য অঞ্চলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন করেছিল। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য দৃঢ় অবস্থান নেয়। তারা মিয়ানমারকে করিডর দেওয়ার প্রস্তাবে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়। এভাবে গত এক বছর বাংলাদেশের বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সশস্ত্র বাহিনী যেন পুরো দেশটাকে আগলে রেখেছে। সশস্ত্র বাহিনী যেন এই দুর্যোগপূর্ণ সময় সত্যিকারের কান্ডারি। তারা যেন আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, মানুষকে পথ দেখাচ্ছে। আর সে কারণেই সশস্ত্র বাহিনী মানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আছে। সামনে নির্বাচন এবং সেখানেও এই সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই এ দেশের মানুষ মনে করছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ একটি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার পথে নতুন যাত্রা শুরু করবে।