ইসলামি শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চান্দ্রমাসের গুরুত্ব অপরিসীম। চান্দ্রমাসের হিসাবমতেই হজ, রোজা প্রভৃতি আদায় করা হয়। তবে কোরআন মজিদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল-তারিখ ঠিক করার মানদণ্ডরূপে অভিহিত করেছে। সে হিসেবে চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সন-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর কাছে অধিকতর পছন্দনীয় হওয়ায় শরিয়তের বিধিবিধানকে চন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাখা হয়েছে। এজন্য চান্দ্রবছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরজে কেফায়া। সব উম্মত এটা ভুলে গেলে সবাই গুনাহগার হবে। হিজরি সনের উদ্ভব ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে। ওই সময় খলিফার কাছে একটি চুক্তিপত্র আনা হয়। সেখানে শাবান মাসের কথা উল্লেখ ছিল। তখন ওমর (রা.) বললেন, এটা কি গত শাবান না আগামী শাবান? তিনি এ-সংক্রান্ত বিভ্রান্তি নিরসনে তারিখ গণনার নির্দেশ দিলেন এবং রসুল (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সন গণনার সূচনা করেন। এ সময় মহররমকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনার মাস ১২টি, আসমানগুলো ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সুরা তওবা, আয়াত ৩৬) এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করিম (সা.) বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং অন্যটি হলো রজব।
মহররম নফল ইবাদতের মাস। ঐতিহাসিক দিক থেকেও এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। ১০ মহররম বা আশুরার দিন রোজা রাখা এ মাসের অন্যতম আমল। রসুলুল্লাহ (সা.) মহররমে আমল করার কথা বলেছেন। আশুরায় রোজা রাখার পাশাপাশি তওবা-ইসতিগফার ও দান-সদকার কথাও বলেছেন। মহররমজুড়ে বেশি বেশি নফল রোজা ও তওবা-ইসতিগফারের প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করেছেন। তাই মাসব্যাপী আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা মোমিন মুসলমানের জন্য একান্ত আবশ্যক। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি রমজানের পর আর কোনো মাসে রোজা রাখতে চাও তবে মহররমে রোজা রাখ। কেননা সেটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন রয়েছে যেদিন আল্লাহ অনেকের তওবা কবুল করেন। ভবিষ্যতেও আরও অনেক মানুষের তওবা কবুল করবেন।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)। মহররমে সবচেয়ে উত্তম হলো কোরআন-হাদিসে বর্ণিত ইসতিগফার-বিষয়ক দোয়াগুলো বুঝে বুঝে পড়া। এ দোয়াগুলোর মাধ্যমে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন বলে আশা করা যায়। রমজানের ফরজ রোজার পর মহররমের নফল রোজার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রসুল (সা.) হিজরতের পর হজরত মুসা (আ.)-এর সুন্নত হিসেবে আশুরার দিন এবং আগের অথবা পরের দিন রোজা পালনের হুকুম দেন। তিনি মদিনায় হিজরতের পর ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা পালন করতে দেখেন। বুখারি ও মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী ইহুদিরা রসুল (সা.)-কে জানান, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মতকে আল্লাহ নাজাত দান করেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে দেন। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর এই কৃপায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এদিন রোজা পালন করেন। তাই ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা পালন করে। রসুল (সা.) ইহুদিদের বলেন, মুসা (আ.)-এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। তিনি এর পর থেকে আশুরায় নিজে রোজা রাখেন এবং মুসলমানদের রোজা রাখার হুকুম দেন। আশুরার রোজা পালনের মাধ্যমে বেশি বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আদম (আ.) থেকে রসুল (সা.) পর্যন্ত সব নবী মহররমকে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। বিশেষত আশুরার দিনে রোজা ও ইবাদত-বন্দেগি করেছেন তাঁরা।
১০ মহররম ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারবালার প্রান্তরে রসুল (সা.)-এর প্রিয় নাতি, হজরত আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.)-এর ছেলে ইমাম হোসাইন (রা.)সহ নবীবংশের শাহাদাতবরণের ঘটনায়। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামি ইমান-আকিদা পরিপন্থি কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার জন্য ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এজন্য তাঁর ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও সঙ্গীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বদলে সত্য ও ন্যায়ের জন্য শাহাদাতবরণকে বেছে নেন।
লেখক : ইসলামি গবেষক