শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

কোরআনের আয়নায় মুমিনের জীবন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

কোরআনের আয়নায় মুমিনের জীবন

জীবনে অসংখ্যবার কোরআন খতম করেছে, কিন্তু অর্থসহ বুঝে একটি আয়াত কিংবা সূরা পড়া হয়নি— এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। কে যেন রটিয়ে দিল অর্থছাড়া কোরআন পড়লেও সওয়াব পাওয়া যায়। সে থেকেই মানুষ সওয়াবের পেছনে ছুটছে নিরন্তর। তাদের জানানো হয়নি কোরআন এসেছে বোঝার জন্য, চিন্তা গবেষণার জন্য। কোরআন সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা না করলে কেয়ামতের দিন প্রিয় নবীর মামলায় আসামি হয়ে মহাপ্রতাপশালী অসীম ক্ষমতাধর আল্লাহর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কোরআন পরিত্যাগের অপরাধে অপরাধী হয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোরআনের তেলাওয়াত হতে হবে নিয়মিত ও পরিকল্পিত। অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত তেলাওয়াত করে কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয়।  প্রতিদিন অল্প অল্প, এক আয়াত-পাঁচ আয়াত করে পড়লেও একটা সময় দেখা যাবে পুরো কোরআন অর্থসহ পড়া শেষ হয়েছে। রমজান মাসের মতোই আমরা কি পারি না প্রতিদিন একটু একটু করে তেলাওয়াত করতে?

বিদায় নিয়েছে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। এক বছর পর ফিরে আসবে এ মাস। রমজানে আমরা সবাই কম-বেশি কোরআন তেলাওয়াত ও চর্চায় অভ্যস্ত হয়েছি। আমরা যারা কোরআন পড়তে পারি না তারাও তারাবিতে কোরআন শোনার মাধ্যমে কোরআনের সংস্পর্শে থেকেছি। রমজান-পরবর্তী বাকি ১১টি মাসও যেন আমরা কোরআনের সংস্পর্শে থাকতে পারি এ চেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য মাসের তুলনায় কোরআন নাজিলের মাস রমজানে কোরআনের তেলাওয়াত ও চর্চা একটু বেশি হবে; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার শুরু হয় রমজানের পর থেকে। রমজানের পর আমরা কোরআন তেলাওয়াত ও চর্চার কথা একেবারেই ভুলে যাই। তা না হলে যে মানুষটি রমজানের এক মাসে পুরো কোরআন শরিফ কয়েকবার পড়ে শেষ করে ফেলতে পারে; সেই মানুষটিই আবার রমজান-পরবর্তী ১১টি মাসে কোরআন পড়ে না একবারও। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন অনেক মুসলমান আছে যারা রমজান ছাড়া বাকি ১১টি মাসে কোরআন ছুঁয়েও দেখে না। আর কোরআন পড়তে পারে না এমন হতভাগা মুসলমানের সংখ্যাও আমাদের দেশে উল্লেখ করার মতোই।

রমজান চলে যাওয়ার পরপরই আমরা কোরআন থেকে নিরাপদ (!) দূরত্বে অবস্থান করি। যা একজন মুমিন-মুসলমানের জন্য তার ইমানের দাবির পরিপন্থী। ইমানের দাবিই হলো মুমিন প্রতিনিয়ত কোরআন তেলাওয়াত করবে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে না তার দৃষ্টান্ত হলো মানুষহীন বসবাসের অযোগ্য বিরান ঘরের মতো। (বুখারি ও মুসলিম।) পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যারা নিয়মিত কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না, কেয়ামতের দিন তাদের বিরুদ্ধে স্বয়ং রসুল নিজে আল্লাহর আদালতে মামলা ঠুকে দেবেন। ‘রসুল বলবেন, হে আমার পালনকর্তা! আমার সম্প্রদায় এ কোরআনকে পরিত্যক্ত করেছে। (সূরা ফোরকান : ৩০।) আলোচ্য আয়াতের আলোকে সব মুফাসসির একমত, কোরআনকে পরিত্যাগ-পরিত্যক্ত করা মহাপাপ। কোরআনকে পরিত্যাগ করা কয়েকভাবে হতে পারে। কোরআন অস্বীকার করা, কোরআন অবিশ্বাস করা, কোরআন সম্পর্কে সন্দেহ করা, কোরআন না পড়া, কোরআন শিখে ভুলে যাওয়া, কোরআনের অর্থ না বোঝা, কোরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা না করা, কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাধা প্রদান করা— এসবই কোরআন পরিত্যাগের অন্তর্ভুক্ত। রসুল (সা.)-এর একান্ত সাহাবি হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোরআন শেখার পর যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করল না, কোরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করল না বরং কোরআনকে ঘরের এক কোণে ঝুলিয়ে রাখল, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর সামনে গলায় ঝুলন্ত কোরআন নিয়ে উপস্থিত হবে। কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! আপনার এ বান্দা আমাকে পরিত্যাগ /পরিত্যক্ত করে রেখেছে। আপনি তার এবং আমার মাঝে ফায়সালা করে দিন। (কুরতুবী।)

কোরআনের ওপর ইমানের দাবি করার পরও নিয়মিত কোরআন না পড়া, কোরআন না বোঝা ও কোরআনের সমাজ কায়েমের জন্য চেষ্টা না করার চেয়ে বড় জুলুম ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এদের সম্পর্কেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘জালেমরা সেদিন (রাগে, ক্ষোভে, অপমানে) নিজ দুই হাত কামড়াতে থাকবে আর বলবে, আমি যদি রসুলের সঙ্গে আপন পথ অবলম্বন করতাম। (অর্থাৎ রসুলের পথে চলতাম।) হায়! আমার দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ বাণী (কোরআন) আসার পরও সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছে। আর শয়তান মানুষকে বিপদকালেই ধোঁকা দিয়ে থাকে। (সুরা ফোরকান : ২৭-২৯)।

পবিত্র কোরআন জীবনঘনিষ্ঠ ঐশী বাণী হওয়ায় এর সঙ্গে বন্ধুত্ব, সখ্য ও ভালোবাসা গড়ে তোলা মুমিন জীবনের অপরিহার্য দাবি। কোরআনকে ভালোবাসতে হবে নিজের জন্য, নিজের মতো করে। কোরআনকে ভালোবাসার মৌলিক দাবি হলো এর তেলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। রসুল (সা.) নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং সাহাবিদের এর তেলাওয়াতের তাগিদ দিতেন। প্রখ্যাত সাহাবি আবুজর গিফারী (রা.)-কে রসুল (সা.) উপদেশ দিয়েছিলেন যে, ‘কোরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরকে অবশ্যই তুমি নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেবে।  কেননা এ আমল তোমার জন্য পৃথিবীতে নূর ও ঊর্ধ্ব জগতে তোমাকে স্মরণ করার কারণ হবে।’ (মিশকাত শরিফ।)

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর