সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমাদের মাহাথির নেই কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাস আছে

মইনুল হোসেন

আমাদের মাহাথির নেই কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাস আছে

ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ থাকলে দুর্নীতি এড়িয়ে চলা যায় না। আর এটাও সত্য সরকারি দুর্নীতি কখনো এক ব্যক্তির দুর্নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। তখন গোটা সরকারি ব্যবস্থাটাই দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। যেমনটি ঘটতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ক্ষেত্রে। তার নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট গতিশীল থাকা সত্ত্বেও তার  পক্ষে পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়নি। তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে এবং এখন তাকে বড় বড় দুর্নীতির মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা তার জন্য রীতিমতো বিব্রতকর।

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি নিশ্চিত ছিলেন এবং ভেবেছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ জমানোটা নিরাপদ ব্যাপার। তার দুর্নীতির লালসার কোনো সীমা ছিল না। অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটনাপ্রবাহ তাকে ভুল প্রমাণ করেছে। নাজিব সরকারের ব্যাপারে একটা বিষয় অবশ্যই বলা প্রয়োজন যে, অবাধ নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাহত করার কোনো চেষ্টা তার সরকার করেনি। মালয়েশিয়ার রাজনীতি থেকে সব মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত হয়নি। তবে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল।

পুলিশের শক্তি এখন আর নাজিবের কোনো সাহায্যে আসছে না। তার নির্দেশে যে পুলিশ আনোয়ার ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করেছিল সেই একই পুলিশ এখন নাজিবকে গ্রেফতার করেছে। মাহাথিরের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে নাজিবের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তাকে জামিন না দেওয়ার ব্যাপারে আদালতের ওপর সরকার কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। বরং অ্যাটর্নি জেনারেল তার জামিনের অনুকূলে সমর্থন দিয়েছেন। এটাই আইনের শাসনের কথা, যা আমাদের দেশে অনুসরণ করা হয় না। ফলে আইনের শাসনের ধারণাটি সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকির মুখে রয়ে গেছে।

কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরু হলে তাকে অপরাধী হিসেবে দেখা ঠিক নয়। আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন অভিযুক্তকে নির্দোষ হিসেবে দেখতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল আদতে দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা। সরকারের অনুগত চাকরিজীবী নন। আমাদের এখানে রাজনীতির নামে চলছে মোসাহেবি এবং দুর্নীতি।

নাজিব এখন আইনের শাসনের নিরাপত্তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অথচ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আনোয়ার ইব্রাহিমকে তিনি এ আইনের শাসনের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং হাস্যকর সব মামলা দিয়ে তাকে বছরের পর বছর জেলে আটক রেখেছিলেন। প্রতিহিংসার রাজনীতি আদতে কোনো রাজনীতিই নয়। যেমন নাজিব হঠাৎ করে ক্ষমতাহীন এবং অসহায় হয়ে পড়েছেন। এখন বুঝতে পারছেন ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেলে পুলিশি শক্তি আর কোনো কাজে আসে না।

রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে জুলুম-পীড়নকারী সরকারের জায়গায় আরও বেশি জুলুম-পীড়নকারী সরকারের আবির্ভাব ঘটে। মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহিম সঠিক সমঝোতায় এসে নিয়মতান্ত্রিক পথে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। মাহাথির এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে তোলার ব্যাপারে পুলিশি শক্তি দিয়ে নাজিব কোনো বাধা দিয়েছেন এমন অভিযোগ শোনা যায় না। আনোয়ার ইব্রাহিমকে একা পেয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি প্রধানমন্ত্রী সব রকমের অসহনশীলতা দেখিয়েছেন। এখন মাহাথিরের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়ায় সরকার সহনশীল হতে বাধ্য হয়েছে। আনোয়ার ইব্রাহিমও পরিবর্তনের ধারায় রাজকীয় ক্ষমা পেয়ে এখন মুক্ত। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে পুলিশি শক্তির ব্যবহার সরকারের জন্য একেবারেই কাম্য নয় এবং পুলিশের জন্যও ক্ষতিকর। নাজিব বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেলে বন্দী রেখে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। কিন্তু পরিবর্তন আনার জন্য আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতায় আসেন মাহাথির।

বাংলাদেশে যে কোনো সংকট মোকাবিলায় পুলিশি শক্তির অপব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের চলার পথে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা দাবিয়ে রাখতে পুলিশি শক্তির ব্যবহার করাটাই সরকারের কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো আলোচনা, কোনো সমঝোতার প্রশ্ন উঠছে না। কোটা পদ্ধতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দাবি করলে ছাত্রদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে পুলিশি শক্তির প্রয়োগ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকার সমর্থক কিছু ছাত্রকে আন্দোলনকারী ছাত্রদের নির্মমভাবে প্রহার করতে দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের সহযোগী ছাত্রদের বেধড়ক মারপিট করতে দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি এবং যারা এ ঘৃণ্য কাজ করেছে তারা সরকারের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাদেরও পুলিশ রেহাই দেয়নি। এ কাজের সচিত্র প্রতিবেদন গণমাধ্যমে এসেছে। এটা সরকারের জন্য সম্মানজনক হতে পারে না। চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভ্রান্ত চিকিৎসার কারণে একটি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না। র‌্যাব এসে পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে ডাক্তারদের ক্ষুব্ধ করল। সবাইকে ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে দেখলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ভদ্র সমাজও আমরা পাব না। কী সব ঘটে চলেছে এবং আমরা কোথায় চলেছি! এখন পুলিশ খতিয়ে দেখছে প্রতিবাদী ছাত্রদের পেছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মদদ আছে কিনা। ইতিমধ্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। এভাবে ছাত্রদের একটি যৌক্তিক ইস্যু বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা দেখার জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এখন রিপোর্ট প্রদানে কালক্ষেপণের মধ্যে ষড়যন্ত্র থাকলেও থাকতে পারে। অন্যত্র ষড়যন্ত্র খুঁজে লাভ হবে না। এটা দুঃখজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক যে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারকে অনেক বেশি পুলিশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার সমস্যার সমাধান করবে রাজনৈতিকভাবে। অথবা তা যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে কোর্টের সাহায্য নিতে পারে। পুলিশ দিয়ে যে কোনো নাগরিককে ঠেঙানো এবং হয়রানি করা ছাড়া সরকারকে দায়িত্বশীল সুশাসনের বিচার বিবেচনায় কোনো সঠিক ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিতে দেখছি না। জাতিকে পুলিশি ভয়ের মধ্যে রাখাও সমীচীন হচ্ছে না। দেশে রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজন তো দেখি না।

যেখানে সমস্যা নেই সেখানেও সরকার নিজেই সমস্যার সৃষ্টি করছে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক ব্যর্থতারই দৃষ্টান্ত। তথাকথিত রাজনীতিবিদরাও এখন পুলিশের কাছে অসহায়। শুধু জনগণ নয়।

সঠিক সমঝোতা করার জন্য মাহাথিরের মতো পরিপক্ব রাজনৈতিক নেতা আমাদের না থাকতে পারে কিন্তু শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের মহান নেতাদের উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি, যারা আমাদের আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পথে চলতে শিখিয়ে গেছেন। এটুকু তো আমাদের সবারই জানার কথা যে, পুলিশি শক্তি রাজনীতি করার জন্য নয়। পুলিশি শক্তির বদলে আইনের শাসন মেনে চলা রাজনৈতিক সরকারের জন্য অবশ্য করণীয়। ক্ষমতাসীনদের নিজেদের ক্ষমতায় থাকার নিরাপত্তার জন্য পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার মোটেও কাম্য নয়। আমরা কেন বলতে পারি না, এ শিক্ষা আমাদের অতীত রাজনীতির শিক্ষা নয়।  প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির ক্ষমতায় আসার জন্য ক্ষমতায় আসেননি। ব্যক্তি নাজিবের বিরুদ্ধেও রাজনীতিতে ফিরে আসেননি। তিনি নিজের দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন রাজনৈতিক সংস্কার আনার জন্য। সে জন্য তিনি দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীও থাকবেন না।  মাহাথির দুর্নীতিনির্ভর রাজনীতির বিপরীতে স্থায়ী অবসানের ব্যবস্থা বা সিস্টেম রেখে যেতে চাচ্ছেন। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির দিকেই আমি আলোকপাত করছি।

আমাদের দেশে যা প্রয়োজন তা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয় নয়। ব্যক্তির পরিবর্তনও কোনো পরিবর্তন আনবে না। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসের আলোকে গণতন্ত্র তথা আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কার্যকর করার দায়িত্ববোধ থেকে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক দল নেই, তাই প্রয়োজন রাজনীতির গণতান্ত্রিক সংস্কার। দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে প্রয়োজন শাসনতন্ত্রসম্মত গণতান্ত্রিক জাতীয় রাজনীতির সরকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা। দলীয় সরকার নয়, জাতীয় সরকার গঠনের মন-মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হওয়াই হবে প্রাথমিক পর্যায়ের দায়িত্ব। দলীয় রাজনীতির গণতন্ত্রায়নের জন্য  কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর