চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা।
দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর’ এর শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি। এ দেবীই হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুরকুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডে শান্তি স্থাপন করেন।
সরকারি বা জাতীয়ভাবে এ উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গা উৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। শরৎকালের বার্ষিক মহাউৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এ উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ তাই বসন্তকালের এ উৎসবকে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়।
মা দুর্গার ১০ হাত রয়েছে বলেই তাকে দশভুজা বলা হয়। তিনটি চোখ এ জন্য তাকে ত্রিনয়নী বলা হয়। মা দুর্গা দেবীর ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে- ত্রিশুল, খড়গ, চক্র, বান ও শক্তি নামক অস্ত্র। বামদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে শঙ্খ, ঢাল, ঘণ্টা, অঙ্কুশ ও পাখা। এসব কিছুই দুর্গাদেবীর অসীম শক্তি ও গুণের প্রতীক। দশদিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধ্ব, অধঃ- এ দশদিক থেকে মা দুর্গার দশটি হাত, যাকে বলা হয় দশপ্রহরণী। দেবী দুর্গা এ দশপ্রহর দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। অন্যদিকে মানব জাতির অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য দেবীকে দশ প্রহরণধারিণী বলা হয়ে থাকে।
রামায়ণে রামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে মা দুর্গাদেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন, অন্যদিকে মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধারম্ভের আগে জয় নিশ্চিত করার জন্য দুর্গাপূজার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মহামায়া দুর্গারূপে দুর্ধর্ষ অশুররাজ মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তার ফলে অসুরবদের অত্যাচার থেকে দেবগণ মুক্ত হয়েছিলেন, ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর স্বর্গ রাজ্য।
শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করার জন্য দেবীর আরাধনায় বসেছিলেন। তখন ছিল শরৎকাল। দেবতাদের নিদ্রার সময় নিদ্রাভঙ্গ করতে রামচন্দ্র অকাল বোধন করলেন। আর সে জন্যই এ পূজাকে তখন অনেকেই অকালবোধন হিসেবে উল্লেখ করেন। এ বোধন হচ্ছে জাগরণ। ষষ্ঠী পূজার সময় সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষমূলে দেবী বন্দনার উদ্দেশে যে বিশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় সেটাকেই বলা হয় বোধন। দুর্গাপূজাতে বোধন ছাড়া দেবীপূজা পরিপূর্ণ হয় না। চৈত্র মাসের বসন্তকালে অকাল বোধনের আগে বসন্তকালে দেবীর পূজা হতো, এ কারণেই দেবী বাসন্তীরূপে পরিচিত।
অসুরবিনাশিনী মাকে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেওয়া হয়-‘হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো’। তোমার আগমনে এ পৃথিবীকে ধন্য কর। কলুষতা মুক্ত কর। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ কর পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে।
বিনাশ কর আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে। মা দুর্গা দেবী কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও অষ্টভুজা আবার কোথাও দশভুজা বা অষ্টাদশভুজা রূপে বর্ণিত, পুজিতা এবং বন্দিতা। চন্ডীতে দুর্গার সহস্রভুজা মূর্তির উল্লেখও করা আছে। দুর্গা কখনো লগ্না, কখনোবা রাজরাজেশ্বরী রূপে অধিষ্ঠত হন। মহাকালী দেবীর তামসী মূর্তি, মহাস্বরস্বতী দেবীর সাত্বিকী মূর্তি, মহালক্ষ্মী দেবীর রাজসী মূর্তি, সবই মা দুর্গা। অন্নপূর্ণা, মনসা, ষষ্ঠী, শীতলা, সুবচনী, গন্ধেশ্বরী এসবই একই মহা প্রকৃতির। শ্রী রামচন্দ্র যখন পূজা দিতে গিয়ে দেখলেন আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন। সীতা উদ্ধারও হবে না। তাই নিরুপায় রামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন, কেননা রামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা রামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা ১০ হাতে ১০ অস্ত্রে সুসজ্জিত, তার ১০ হাত ১০ দিক রক্ষার প্রতীক। মূলে তিনি এক পরমবিদ্যা স্বরূপিনী, যিনি সর্বভূতের প্রাণরূপী মহা দিব্য মূর্তি মা ও জগৎ মঙ্গলময়ী দুর্গা। দুর্গাপূজা উৎসবে বহুকাল থেকেই মহিলারা মায়ের চরণে বসে পূজার পরে সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান শুরু করে। এই সিঁদুর খেলা দুর্গাদেবীর আশীর্বাদ পেতে আয়োজন করা হয়। অনেকে বলেন, এর মাধ্যমে বিবাহিত মহিলাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি আলাদাভাবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অংশ মাত্র। এর ইতিহাস অনেক আগের প্রায় ৪৫০ বছরের পুরনো। অর্থাৎ দেবী দুর্গাকে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে বিদায় জানানোর সময় সিঁদুর পরিয়ে দেন। সেই থেকেই সিঁদুর দানের জন্ম।
অষ্টমীতে কুমারী পূজা-সনাতন ধর্ম মতে কুমারী পূজা হলো ষোল বছরের কম বয়সি অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। শারদীয় দুর্গাপূজার অংশ হিসেবে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন চলে আসছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট হবিগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলা শহরের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। প্রতি বছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। পুরাণ মতে, দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। এদিন নির্বাচিত কুমারীকে ¯œান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক ও পায়ে আলতা। ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক মুখরিত হয় শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে।
দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক। তিনি জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। শ্রী শ্রী চন্ডীতে মহামায়ার স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে-তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস, তাঁর অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তাঁর শক্তিতেই আমার শক্তিমান। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তাঁরই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাঁকেই লাভ করার চেষ্টা করি। দুর্গাপূজা সমাজের সব বর্ণ, শ্রেণি ও পেশার, সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সবার কল্যাণ ভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডানপাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পার্শে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক।
হিন্দু শাস্ত্র মতে- দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। দুর্গার শাস্ত্রীয় স্বরূপ হলো: তিনি শাশ্বত, মহাকাল ও সনাতনী, তিনিই নিয়তি ও নিয়ন্তা। দুর্গার এ গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু দেবী মাত্র নন, তিনি ঈশ্বর।
মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্র্ভূতা, এ পূজোর মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য, বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (স্বরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। পুরনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে, সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা, কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়, একেই বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়, যার নাম ‘সন্ধিপূজা’। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয় ও মনকে একাগ্র করার ও শুদ্ধ করার প্রয়াস পাই। আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হলে মা আমাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন, আমরা আমাদের আনন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করি। মা শরণাগত সন্তানকে দশ হাতে সতত সর্ব প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন এবং পরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস-মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা
Email : [email protected]