মাসদার হোসেন। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক ঘটনা। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছিল উচ্চ আদালতের একটি মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই ঐতিহাসিক মামলার বাদী ছিলেন সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন। ‘মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র’ মামলার রায়েই স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। সে রায় বাস্তবায়ন নিয়ে মাসদার হোসেন তাঁর আক্ষেপ, মামলার পেছনের ঘটনা ও বিচার বিভাগ নিয়ে নিজের প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে। তিনি বর্তমানে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আরাফাত মুন্না
বাংলাদেশ প্রতিদিন : মাসদার হোসেন নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক অধ্যায়। যা মাসদার হোসেন মামলা হিসেবে পরিচিত। এ মামলা করার সময় কি আপনি ভেবেছিলেন যে, আপনার এই মামলাই একসময় দেশের রাজনীতিতে আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তুতে পরিণত হবে?
মাসদার হোসেন : বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সংগত ও সময়োপযোগী একটা প্রশ্নের জন্য। যে মুহূর্তে মামলাটি হয়, সে মুহূর্তে আমরা ভেবেছিলাম। এখনো জীবিত রয়েছেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, মাসদার সাহেব আপনারা কি ভাবতে পারছেন এটা এক দিন ইতিহাস হবে? মামলা তখনো হাই কোর্টে ফাইল হয়নি। আমি সেদিনই তাঁকে বলেছিলাম, আমরা কিছুটা অনুমান করছি। কারণ সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো এতদিন অস্পষ্ট ছিল, সেটা এখন স্পষ্ট হবে জাতির কাছে। এটা সাধারণ মানুষের কল্যাণে হওয়াই উচিত। তবে এখন যেভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, সেটা ওই সময় ভাবিনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার শুরুটা কীভাবে হলো?
মাসদার হোসেন : আমরা বিচার বিভাগের কর্মকর্তা বা বিচারক হওয়ার পর যেসব মামলার শুনানি করি, প্রতিটি মামলারই একটা বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। বিচার্য বিষয় নির্ধারণের পূর্বে মামলা করারও একটি কারণ নির্ধারণ হয়। কোনো কারণ ছাড়া মামলা হয় না। এ মামলাটির (মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র) পেছনের কারণ অত্যন্ত দুঃখজনক। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, বিচার বিভাগের জন্য এটি আলোচিত হওয়া উচিত।
ডাক্তারকে দিয়ে যেমন রাস্তা বানানো যাবে না, ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে যেমন রোগীর চিকিৎসা সম্ভব নয়, ঠিক বিচার বিভাগের কাজও দক্ষ অভিজ্ঞ বিচারকদের দিয়েই করতে হবে। ওই সময়ে (মামলা দায়েরকালীন) আমরা দেখলাম বিচার বিভাগের কাজ পরিপূর্ণভাবে বিচার বিভাগ থেকে হয় না। এ কষ্টটা দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগের বিচারকরা অনুভব করেছেন। এ মামলাটা ওই সময়ে করার একটা কারণ তৈরি হয়েছিল। কারণটা হচ্ছে, বিচারকরা যে স্কেলে বেতন-ভাতা পেয়ে আসছিলেন, সেটা কোনো কারণ ছাড়াই একধাপ অবনমন করে দেওয়া হয়। সব ক্যাডারের সঙ্গে বিচারকদের বেতনও একধাপ উন্নীত করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর দেখা গেল সব ক্যাডারের বেতন উন্নীত পর্যায়েই রয়েছে, কিন্তু বিচারকদের বেতন স্কেলটা ঠিক নেই। একধাপ অবনমন করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে অনেক বিচারক (সেই সময়) বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। কেউ কেউ ১৮ মাস, কেউ আরও অধিক সময় বেতন নিলেন না। তখন বিচার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে মামলাটা আমি করি।
তবে এ মামলা করতে গিয়ে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। তখন বেতন-ভাতাটাই ছিল মুখ্য কারণ। কিন্তু দীর্ঘদিন বিচার বিভাগে কর্মপরিবেশ না থাকা, জনগণের বিচারহীনতা, আইনের ছাত্র হিসেবে, বিচারক হিসেবে, এসব বিষয় আমাদের পীড়িত করত। কষ্ট দিত। বেতন স্কেলের ঘটনাটায় আমাদের সুযোগ এলো। আমরা পরিপূর্ণভাবে বিচার বিভাগের স্বকীয়তা নিয়ে এবং পৃথকভাবে জনকল্যাণে ও জনস্বার্থে এ মামলা করার মনস্থির করলাম। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করার পর এ মামলার পরিপূর্ণ আঙ্গিক সাজালাম। এরপর মামলাটি ফাইল করা হলো।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামকে কীভাবে যুক্ত করা হয়েছে এ মামলায়?
মাসদার হোসেন : আমি তখন ঢাকা কোর্টে সাবজজ হিসেবে কর্মরত। আমাদের কোর্টে অনেক ব্যারিস্টার, বড় আইনজীবী মামলা করতে আসতেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মোজাম্মেল হকও (তখনো বিচারপতি হননি) আমার কোর্টে মামলা করতে আসতেন আইনজীবী হিসেবে। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামও আসতেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে। যখন আমাদের সমস্যাটা দেখা দিল, তখন আমরা সর্বপ্রথম ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের চেম্বারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করলাম। তিনি আমাদের কিছু ভালো পরামর্শ দিলেন। পরবর্তীতে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের সবাই মিলে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের চেম্বারে গেলাম। তিনি আমাদের বললেন, ‘আপনারা আগে ঠিক করেন, আপনারা কী করতে চান? আপনারা তো বিচারক।’ তখন আমরা আমাদের পরিষদ নিয়ে বসে রিটের একটা ড্রাফট তৈরি করলাম। তারপর ওনার (ব্যারিস্টার আমীর) কাছে গেলাম। উনি খুব খুশি হলেন। উনি বললেন, ‘এটা তো ঐতিহাসিক একটা মামলা হবে।’ এ মামলার শুরুতেই ড. কামাল হোসেন, শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ যুক্ত হলেন।
আমার মনে আছে স্পষ্ট। শুরুতে আমরা যখন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে মৌচাকের কসমস টাওয়ারে বসলাম তিনি বললেন, ‘আপনাদের এ মামলা চলবে না। আপনাদের কোনো অভিযোগ থাকলে আপনারা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে যাবেন আপনাদের সমস্যার সমাধানে।’ তখন আমরা তাঁকে বোঝালাম। বললাম, আমরা আমাদের চাকরির সমস্যা নিয়ে আসিনি। বেআইনিভাবে বিচারকদের প্রশাসনের আন্ডারে রাখা হয়েছে। আমরা বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশন। রুল অব ল অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে বিচার বিভাগ সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আমরা তো কারও নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারি না। বরং আইন বিভাগ যে আইন পাস করবে, সেটা জনবান্ধব হয়েছে কি না, সেটাও বিচার বিভাগ দেখবে। প্রশাসন দেশ চালাবে, সেখানে জনগণের স্বার্থরক্ষা হয়েছে কি না, সেটাও বিচার বিভাগ দেখবে। এ কারণে আমাদের সুপ্রিমেসি অন্যদের ওপরে রাখা ঠিক হবে না। বিচারকদের ইনক্যাডারমেন্ট করাই ছিল আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, রিটে এটাই আমাদের মূল আর্জি ছিল।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এত সিনিয়র আইনজীবী এ মামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর পরেও রায়ের ১২ দফা নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ কী?
মাসদার হোসেন : কথাটা তিক্ত হবে। এর পরেও জাতির সামনে বলা উচিত, একটা দেশের বিচার বিভাগ হবে জনগণের স্বার্থে। পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগসহ সবকিছুই জনগণের স্বার্থে হবে। আমরা মুখে বলি আমরা ‘সেবক’। কিন্তু জনগণের স্বার্থ যদি বিচার বিভাগ দ্বারা, আইন বিভাগ দ্বারা, নির্বাহী বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত না হয়, তাহলে তো আমাদের প্রয়োজন নেই। কোনো বিভাগেরই প্রয়োজন নেই।
আমাদের দেশে আপনারা কালাকানুন বলেন- যে কালো আইনগুলো করে বাকস্বাধীনতা বন্ধ করা হয়েছে। সভা করার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। চলাচলে রেস্ট্রিকশন (বাধা) দিচ্ছে। ওই আইনগুলো সংবিধান সমর্থন করে না। এসব কারণেই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, জনকল্যাণে তাদের কার্য পরিচালনা করুক, আমরা সেটা চেয়েছিলাম। রায়ের পর সিনিয়র আইনজীবীসহ অনেকেই চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনো চূড়ান্ত ফলাফল এখনো আসেনি।
নিম্ন আদালত থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত বিচার বিভাগে যেসব রায় হয়, এ রায়গুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রশাসনের। তারা যদি এ রায় বাস্তবায়ন না করে, এর দায় কার? রায় কার্যকর না করা দুঃখজনক। তবে এ রায় বাস্তবায়নে সরকার অবহেলা করেছে, বিষয়টা এমনও নয়। এখানে কিছু সময় প্রয়োজন হয়। অন্যগুলো সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে। তাই কিছু সময় অতিরিক্ত লেগেছে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে কী হিসেবে দেখেন?
মাসদার হোসেন : আমি এটাকে খুবই আশাব্যঞ্জক ও জাতির জন্য বড় পাওয়া বলে মনে করি। এই যে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক হলো, এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কিন্তু পরবর্তী সরকার এসে এটাকে বৈধতা দিয়েছে। এরপর আর তেমন কিছুই হয়নি। আমাদের আকাক্সক্ষা, রায় যেন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২০১৭ সালে সিনিয়র আইনজীবীদের এ মামলা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানতেন কি না, জানলে কীভাবে দেখেন? আর কেন তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছিল?
মাসদার হোসেন : এটা সত্যি অমানবিক বিষয়। তৎকালীন আইন সচিব যখন প্রজ্ঞাপনটা আমাকে দিলেন, আমি খুবই ব্যথিত হয়েছিলাম। সচিব জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একটা পদে ছিলেন। তিনি বিচার বিভাগীয় কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। এটা তাঁর সাচিবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বিশেষ উদ্দেশ্যে এ মামলা থেকে সিনিয়র আইনজীবীদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এটা অনাহুত, অনাকাক্সিক্ষত ছিল। সেদিনই আমি সুপ্রিম কোর্টে ব্যারিস্টার আমীর, ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করি। বিশেষ করে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে বলি আপনি ঘাবড়াবেন না। আমরা বিচারকরা আপনার সঙ্গে আছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : মামলার বাদী হিসেবে রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
মাসদার হোসেন : ‘পৃথকীকরণ’ শব্দের মাধ্যমেই সাধারণ একজন মানুষ বুঝবে, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গ থেকে তার পৃথকীকরণ চাচ্ছে। রায়ের ১২ দফার ৮ নম্বর দফায় পরিষ্কারভাবে আপিল বিভাগ বলে দিয়েছেন, সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে বিচার বিভাগীয় সদস্যদের। অর্থাৎ সহকারী জজ থেকে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত, এদের কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করা যাবে না। তাঁদের ওপর ওহি নাজিল করা যাবে না।
জাতি জানে, আমাদের বিচার বিভাগ কীভাবে কাজ করেছে। তার স্বকীয়তা নিয়ে চলেছে, নাকি ফরমায়েশি কাজ করেছে। এটা বলতে আমার কষ্ট লাগছে। এর পরেও এটা লুকালে চলবে না। যারা বিচার বিভাগের সঙ্গে জড়িত নয়, আপামর জনসাধারণ, তাঁরাও এটা জানে। আর বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা জানেন, বিচার বিভাগ এতদিন কীভাবে চলেছে আমাদের দেশে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এ মামলা করার সময় আপনি চাকরিতে ছিলেন। মামলা করার কারণে চাকরিজীবনে কোনো ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না?
মাসদার হোসেন : এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, এর পরেও জাতির কাছে দু-একটি বিষয় বলা উচিত। মামলার শুরুতে খুবই প্রতিবন্ধকতার শিকার হই। মামলাটি ফাইল করতে পারছিলাম না। ওই সময় আমাদের জুডিশিয়াল অফিসাররা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমাদের সিনিয়র অফিসাররা ভীত ছিলেন আমাদের চাকরি নিয়ে। এর পরেও মামলাটা করেছিলাম।
এ মামলার কারণে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগের অনেক অফিসার মামলা করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমিও অনেক ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছি। বলতেও খুব কষ্ট হচ্ছে, সারাজীবন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি করার পরেও আমার মৌলিক অধিকার পেনশনটাও সঠিক সময়ে দেওয়া হয়নি। অত্যন্ত করুণ বিষয় হচ্ছে, অনেক বিচারককে এ মামলার সঙ্গে (জড়িত) থাকার কারণে চাকরি হারাতে হয়েছে। আমার জানা মতে, ন্যায়বিচার করতে গিয়ে ডজনখানেক অফিসার চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ফিরোজ আলম, আবদুর রহমান, মঈনুদ্দিনের মতো ব্রাইট অফিসারকে জোর করে চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় আমরা সহ্য করে নিয়েছি, জাতিকে আরও ভালো কিছু দেওয়ার জন্য। অবশেষে আমাদের বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে, হয়তো এক দিন জাতি এর সুফল ভোগ করবে, এই আশায়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অবসরজীবন কীভাবে কাটাচ্ছেন?
মাসদার হোসেন : আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে সরাসরি বিচারকের চেয়ারে যাই। মহান আল্লাহ প্রায় চার দশক বিচারকের চেয়ারে আমাকে রেখেছিলেন। তখন ব্যস্ততা অনেক ছিল। গভীর রাতে বসে বসে রায় লিখতে হতো। অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তখন যে পড়াশোনা এবং কষ্ট ছিল, এখন তার চেয়ে বেশি পড়াশোনা করতে হচ্ছে, সময় দিতে হচ্ছে। এখন আমি সুপ্রিম কোর্টে কাজ করি। আইন নিয়েই আছি। লেখালেখি করি। আমার বেশ কিছু প্রকাশনা রয়েছে আইনের ওপরে। বড় কাজ আছে, আল্লাহ যদি আমাকে হায়াত দেন, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও রুল অব ল-এর ওপরে একটি বড় কাজ জাতিকে উপহার দিতে পারব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : নতুন বাংলাদেশে বিচার বিভাগ নিয়ে কী স্বপ্ন দেখছেন?
মাসদার হোসেন : এর উত্তর বলতে হলে, আমাকে অপ্রিয় অনেক কথাই বলতে হবে। সারা পৃথিবীর দিকে যদি তাকাই, কয়েকটি দেশ বাদে বিচার বিভাগের অবস্থা কোনো দেশেই সুখকর নয়। কয়েকটি দেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং বিচার বিভাগ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই। সেসব দেশে বিচার বিভাগ দ্বারা জনকল্যাণে কাজ করার পরিবেশ নেই। আমাদের দেশে যে আশার আলো আমরা দেখছি, এই নতুন প্রজন্ম আমাদের যে নতুন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, যে কারণে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, এজন্য আন্তরিকভাবে তাদের ধন্যবাদ জানাই।
তবে আমার মনে অনেক আশঙ্কা রয়ে গেছে। এখন যে সংস্কার, বিচার বিভাগসহ সব বিভাগ নতুন করে সাজাতে চেষ্টাও চলছে। তবে এটা কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। কারণ আপনাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার কোনো সাংবিধানিক সরকার নয়। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার নয়। আমাদের সংবিধানের বর্তমান যা হাল, এই সংবিধানে হাত দেওয়ার কোনো অবস্থা নেই। এই সংবিধানের একটি আর্টিকেলের (অনুচ্ছেদ) সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক। এ ধরনের একটি অকার্যকর সংবিধান রেখে এ দেশের জনকল্যাণ বা ভবিষ্যৎ সংস্কার কোনো কিছুই সাসটেইনেবল (টেকসই) হবে না। সংরক্ষণ হবে না। এজন্যই আমি শঙ্কিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের একা একা কোনো কিছু করাই ঠিক হবে না। যে রাজনৈতিক দলগুলো এখন কার্যকর, সবার সঙ্গে আলোচনা করা, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ, সবার মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ২০১০ সালে তিউনিসিয়াতে এরকম একটি বিপ্লবী সরকার এলো এবং বিপ্লবী সরকার এক বছর পরিশ্রম করে আগের সংবিধান, যেটা দুর্নীতি ও অন্যায়ের কেন্দ্র ছিল, সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে নতুন একটি সুন্দর সংবিধান তৈরি করল। ২০১১ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর করল। পরে ২০১৪ সালে এই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিল। নির্বাচনে যে সরকার এলো জনগণের নির্বাচিত, সেই সরকার ক্ষমতায় এসেই পরের দিন নতুন সংবিধানকে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। এই ইতিহাস আমাকে তাড়িত করে। আমাদের দেশের যারা এই সংস্কারে জড়িত, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমি অনুরোধ করব, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করুন। যারা ভবিষ্যতে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ চালাতে আসবেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করুন। তাহলে এই সংস্কারের উদ্যোগ কার্যকর হবে এবং জনকল্যাণে অবদান রাখতে পারবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রায়ের অন্যতম বিষয় বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়, যেটা এত বছরেও হয়নি। আইনজীবীরা বলেন, কোনো রাজনৈতিক সরকার পৃথক সচিবালয় করে ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
মাসদার হোসেন : গত ২১ সেপ্টেম্বর বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির দেওয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল, তিনজনই আমাদের যে আশার আলো দেখিয়েছেন আমরা সত্যিই আশাবাদী, বিচার বিভাগ এবার সত্যিই স্বাধীন হবে। কিন্তু এখানে বলে রাখি, আপনাদের মনে রাখতে হবে, মাসদার হোসেন মামলায় কোথাও পৃথক সচিবালয়ের কথা বলা নেই। আমি একটু আগেই বলেছি, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে বিচার বিভাগকে। না হলে এই পৃথকীকরণ কোনো কাজে আসবে না। সেই দফার আলোকে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে একটি প্রতিষ্ঠান লাগবে, সেটা সচিবালয় বা যে নামেই ডাকি। এসব করতে হলে একটি রুল ফ্রেম করতে হবে। রুল ফ্রেম করতে হলে সংবিধানের ১৬, ১৩৩, ১৩৪ অনুচ্ছেদের বিষয়ে ভাবতে হবে। যারা সংবিধান সংস্কারের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের এখানে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, এখনই মোক্ষম সময়। কারণ এটা তিক্ত হলেও সত্য, এর আগে কোনো রাজনৈতিক সরকারই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কোনো অবদান রাখেনি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার চলছে, এখনই আমাদের জন্য সুযোগ। বিচার বিভাগ যেন পরিপূর্ণভাবে তার স্বকীয়তা নিয়ে চলতে পারে, বিচার বিভাগের জন্য পৃথকভাবে বিচার বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা যদি করা হয়, তাহলে জনগণ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য। আপনি কি মনে করেন এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো বাধা থাকতে পারে?
মাসদার হোসেন : যে কমিশনগুলো করা হয়েছে, এটা খুবই ভালো বিষয়। অভিজ্ঞদের নিয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আমার মনে হয় এই কলেবরকে আরেকটু বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আর আগেই বলেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা ভবিষ্যতে দেশ শাসন করবে, তাঁদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞ তাঁদের এই কমিশনগুলোতে যুক্ত করা উচিত। কারণ ভবিষ্যৎ দেশ চালাবেন তাঁরাই। তাহলে এই সংস্কারগুলো, এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর হবে এবং ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : পরিশেষে বিচার বিভাগ নিয়ে আপনার প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে যদি কিছু বলতে চান?
মাসদার হোসেন : আমি একজন সচেতন নাগরিক এবং এ দেশের জনগণের একজন সেবক হিসেবে বলব- আমাদের দেশে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার আইন। তবে আমার প্রশ্ন জনকল্যাণে এ আইনগুলো কতটুকু কার্যকর। সেটা ভাবতে হবে। এজন্য আইন বিভাগকে ভালো আইন তৈরি করতে হবে। যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন ঠিক থাকে। দেশের টাকা যেন বিদেশে চলে না যায়। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের সব প্রকল্প যেন ব্যর্থতায় পরিণত না হয়। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় আমার বলা উচিত, যারা সরকারের দায়িত্বে থাকবে, নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে থাকবে তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। বিচার বিভাগ অযথা তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তেমনি আইন বিভাগকেও নিরপেক্ষভাবে আইন তৈরির অধিকার দিতে হবে। সংবিধানের ৭৩ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে গলা টিপে ধরলে কীভাবে আইন তৈরি করবে? রাষ্ট্রের সব অর্গানকেই স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। আমার মনে হয়, এতে দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে।
আমাদের দেশের জনগণ কিন্তু বিচার বিভাগ নিয়ে ভালো ধারণা পোষণ করে না। গ্রামে অনেক সময়ই নিজের শত্রুকে অভিশাপ দেয়, তার ঘরে মামলা ঢুকুক বলে। মানে মামলা ঢুকলে যুগ যুগে শেষ হবে না। আমি মামলা করেছি, ৬৫ বছর চলছে ওই মামলা। এই বিচার বিভাগ দিয়ে কি জনগণের অধিকার রক্ষা হবে। রাষ্ট্রের সব অর্গানকেই জনকল্যাণে নিবেদিত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাসদার হোসেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।