বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা-আগুনের নেপথ্য

প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দলীয় কোন্দল

সাখাওয়াত কাওসার

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন মৌখিকভাবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতকে নাসিরনগর কলেজ মোড়ে ও খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতকে (কওমিপন্থি, তৌহিদী জনতা) আশুতোষ স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করার অনুমতি দিলেও জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করেননি। তবে দীর্ঘদিন ধরেই চলমান আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাকে চরম ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমনই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

গত ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা ১৬ মিনিটে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর একটি ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর দিবাগত রাতে নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে এবং বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইনের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুরসহ লুটপাটের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। উত্তেজনা প্রশমনে নাসিরনগর থানা পুলিশও যথার্থ গুরুত্ব আরোপ করেনি। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করলে ওই ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কোন্দল বিরাজ করছিল। হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক আহমেদ এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত বর্তমান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান আঁখির মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন বিএনপিপন্থি সাবেক চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, হরিপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি হাজী মো. বিল্লাল মিয়া। তারা উপজেলা আওয়ামী লীগ, জেলা আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বিল্লাল মিয়া গত ৩০ অক্টোবর রবিবার ভোরে জেলার বিজয়নগর উপজেলার সাতবর্গ নামক ট্রাক স্ট্যান্ডে গিয়ে হরিপুর থেকে নাসিরনগরের সমাবেশস্থলে লোক পাঠানোর জন্য হবিগঞ্জ মাধবপুরের অলকপুর গ্রামের ট্রাক ড্রাইভার ফারুকের মাধ্যমে ৭টি ট্রাক ভাড়া করেন। বিল্লাল নিজের একটি ট্রাক্টরসহ আরও ৬টি ট্রাক লোকজন বহনের জন্য ঠিক করে রাখেন। সমাবেশে যোগদানের জন্য হরিপুরসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা, বিজয়নগর ও আশপাশের এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার বিশেষ করে যুবক শ্রেণির ক্যাডারদের লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রসহ প্রস্তুত রাখা হয়। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দু মন্দিরসহ বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট।

৩০ অক্টোবর ভোরে স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদের মাইক থেকে মুসলিম জনতাকে প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদানের জন্য বলা হয়। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে অনুমান ১০০০ লোক হাতে লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রসহ মিছিল করতে করতে প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেয়। তাদের পাশাপাশি সিএনজি ও অটোরিকশা করে এবং হেঁটে ১০০০-১২০০ লোক সমাবেশে যোগ দেয়। সমাবেশ থেকেও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়। সমাবেশ চলাকালে একপর্যায়ে তারা নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, কাশিপাড়া, ঘোষপাড়া, নমশূদ্রপাড়া, সূত্রধর পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা করে মূর্তি ভাঙচুরসহ মন্দিরের পূজার জিনিসপত্র লুটপাট করে, তাদের বাড়িঘরে হামলা করে দরজা, জানালা, টিনের ঘেরা ভাঙচুর করে এবং তাদের অনেককে মারধর করে। হামলাকারীদের স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা বোরকা পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দির চিনিয়ে দিতে সহযোগিতা করে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি সার্বজনীন মন্দির, ১১টি পারিবারিক মন্দির এবং প্রায় ১০০টির মতো ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ঘটনার পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ভোর সাড়ে ৩টার দিকে নাসিরনগরের দত্তপাড়া, বণিকপাড়া ও পশ্চিমপাড়ার ৬টি বাড়ির ৫টিতে গোয়ালঘর, রান্নাঘর, লাকড়ির ঘর এবং একটি পারিবারিক দুর্গা মন্দিরের আংশিক অংশে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। ওই ঘটনার আলোকে ৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় পাড়াভিত্তিক কমিটি গঠনপূর্বক এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো এলাকায় ফোর্স মোতায়েন আছে। পরিস্থিতি নজরাধীন।  প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, ৩০ অক্টোবর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সময় নাসিরনগর থানায় পর্যাপ্ত অফিসার ও ফোর্স ছিল না। ৩১ অক্টোবর জেলার চারটি থানায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থাকায় ওই থানার অধিকাংশ অফিসার ও ফোর্স ৩০ অক্টোবর সকাল থেকে নির্বাচনী ডিউটি সংক্রান্তে ব্রিফিং প্যারেডে ছিল। অন্যদিকে, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, স্থানীয় দুই এমপির মধ্যে দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব চলছিল। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৩টি ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এ বিষয়টি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ইউনিয়ন নির্বাচনে এক এমপি ১১ জন, অন্যজন ২ প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি দলীয় হাইকমান্ডও অবগত ছিল। ওই কোন্দলকে সামনে রেখে গত ২৭ অক্টোবর হরিণবেড় এলাকার রসরাজ দাস নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট স্থানীয় আল-আমিন সাইবার ক্যাফে থেকে হ্যাক করে ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশলে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তবে ওই হামলায় পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন স্থানীয় বিএনপির শেখ জামাল, আওয়ামী লীগ নেতা এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার, আতিকুর রহমান আঁখি, হাজী ফারুক মিয়া, এমবি কানিজ, আল আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক জাহাঙ্গীর প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর