শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ওরা সবাই এখন বিধবা

স্বপ্নভঙ্গ পাঁচ কিশোরীর

মাহমুদ আজহার, থাইংখালী (কক্সবাজার) থেকে

ওরা সবাই এখন বিধবা

বিধবা দুই নারী। শরণার্থী শিবিরগুলোতে এরকম অনেকেরই আশ্রয় হয়েছে। কেউ কেউ হারিয়েছেন স্বামী-সন্তানসহ সবাইকে। উখিয়া থেকে গতকাল তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

লাইলী বেগম। মিয়ানমারের চাইন্দাপাড়া থেকে পালিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ হয়ে কুতুপালংয়ে একটি রাস্তার ধারেই এখন তার ঠিকানা। স্বামী মো. রফিকুল ইসলামকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তার সামনেই গুলি করে মেরে ফেলে। বারো বছরের নিচে পিঠাপিঠি চার ছেলে তৈয়ব, আহমেদ আলম, মো. আইয়াজ ও মো. ইউনূসকে নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসেন  তিনি। এখনো খোলা আকাশই ঠিকানা এই বিধবা নারীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাইলী বেগম নিজের ভাষায় জানান, ‘আই এখন কডে যাইয়ুম। চার পোয়াকে কনে চাইবো। আল্লা আরে বাঁচাও।’ এই আর্তনাদ শুধু লাইলী বেগমেরই নয়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অধিকাংশ নারীরই। তাদের পরিচয় এখন ‘বিধবা’। তাদের স্বামীর পাশাপাশি ছেলে মেয়ে ও ভাইবোনদের হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেক বিধবা নারীকে ধর্ষণও করেছে। প্রাণ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসার সময় কেড়ে নিয়েছে শেষ সম্বল গায়ে থাকা স্বর্ণালঙ্কারও। সহায় সম্পদ তো আগেই হাতছাড়া। মিয়ানমারের উদয়ং থেকে প্রাণ নিয়ে থাইংখালী পালিয়ে এসেছেন রেহেনা খাতুন নামে এক মধ্যবয়সী নারী। তার স্বামী দ্বীন মোহাম্মদের একটি দোকান ছিল স্থানীয় বাজারে। সেখানে মগরা ঢুকে তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার বাড়িতে আগুন দেওয়ার আগেই তিন ছেলে এনামুল, আসমত উল্লাহ, হেদায়েতুল্লাহ ও তিন মেয়ে আসমা, সাদিয়া ও সাদেকাকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। লুনা বেগম নামে সাত মাসের আরেক গর্ভবর্তী নারীর সঙ্গে কথা হয় একই এলাকায়। মিয়ানমারের নাইকং থেকে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে শিলখালীতে অনুপ্রবেশ করেন। এক ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে কোলে এক বাচ্চাকে নিয়ে ১৫ দিনে বাংলাদেশে আসেন। তার স্বামী রবি আলমকেও গুলি করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। একইসঙ্গে মসজিদ জ্বালিয়ে বাবা আবদুল্লাহকেও পুড়িয়ে মেরেছে তারা। এখন তার ঠিকানা টেংখালীর জামতলা মাঠে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন তার কথা হয়, তখন তিনি অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন।

আয়েশা, ওসমানী, রাইজু ও ঝরনাতারা—চার তরুণী মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন সালমা খাতুন। তিনি ও নাইচং থেকে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। ২৫ আগস্টের রাতে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় পুলিশ। জেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও পরে তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। এরপরদিনই যুবতী চার কন্যাকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে পাড়ি দেন বাংলাদেশের উদ্দেশে। অনেক কষ্টে এখন তার ঠিকানা হয়েছে পালংখালীর রাস্তার পাশে। মিয়ানমার থেকে আগত ১৫ জন নারীর সঙ্গে কথা ছয়, তারা বলছেন স্বামী নেই। তরুণ ছেলেও হারিয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন, তার সামনেই নিজের যুবতী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণই শেষ নয়, ধর্ষিতার হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে ছেঁকা দেওয়া হয়েছে। মেরে ফেলা হয়েছে অনেক তরুণীকে।

বালুখালী এলাকায় এক শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নেওয়া মরিয়ম বিবি (৬৫) জানান, যুবক, যুবতী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও পৃথক লাইন করা হতো। তরুণ-যুবকদের পৃথক লাইনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুবতীদের নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা স্থানে। সেখানে বার্মিজ মিলিটারি ও পুলিশরা যুবতীদের গণধর্ষণ করে। এমনকি অনেক মেয়েকে হত্যাও করা হয়। কেউ কেউ কাকুতি মিনতি করে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের চরম নির্যাতন করে বলা হয়, তোরা দ্রুত বাংলাদেশে চলে যা। ওটাই তোদের ঠিকানা। টেকনাফে রোহিঙ্গা শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার : টেকনাফ উপকূল থেকে আরও এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে ভেসে আসা রোহিঙ্গা শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।  টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)  মো. মাইন উদ্দিন খান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপ উপকূলের কাছে সাগরে রোহিঙ্গাবাহী দুটি নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় আজ দুপুরে আরও এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও অনেকে নিখোঁজ থাকতে পারে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বাংলাদেশিও রয়েছে।’ টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘নিখোঁজ বাংলাদেশির নাম  মো. শাকের (৩০)। তিনি শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা আলী  হোসেনের ছেলে। শাকের একটি নৌকার মাঝির সহকারী ছিলেন। এদিকে গতকালও মিয়ানমার সীমান্তের কয়েকটি গ্রামে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

স্বপ্নভঙ্গ পাঁচ কিশোরীর : শওকত আরা, ইয়াসমিন আরা, ফাতেমা বেগম, রাশেদা বেগম ও দিলতাজ খাতুন। পাঁচজনই রোহিঙ্গা কিশোরী। তাদের কারোই বয়স বারো পেরোয়নি। তারা দিগ্বিজয়ী কেউ নয়। শিল্পী, মডেল কিংবা সুপারস্টারও নয়। তবে অন্য সাধারণ কিশোরীদের মতো নিজেদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত তারা। মুক্তবিহঙ্গের মতো ছুটে বেড়াত এ পাড়া থেকে ওপাড়া। নিজ পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে খেলাধুলা করা, গাছে ওঠা, পুকুরে দৌড়ঝাঁপ করা কিংবা সকাল সকাল স্কুল বা মক্তবে যাওয়াই ছিল ওদের নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু শুরুতেই থমকে যায় তাদের জীবন। শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ। জন্মভূমি থেকে পালিয়ে আসতে হয় জীবন বাঁচাতে। আশ্রয় জোটে ৮ ফুট বাই ১০ ফুট অস্থায়ী ক্যাম্পে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা এই কিশোরীদের নানা বাধা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সেখানে নিজ জন্মভূমিতে যেটুকু স্বপ্ন দেখে বড় হচ্ছিল এখানে এসে সেটুকুরও অস্তিত্ব নেই। আশ্রয় নেওয়া একেকটি তাঁবুর মতোই ছোট হয়ে আসে তাদের পৃথিবী। মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় সব স্বপ্ন। থেমে যায় চাওয়া-পাওয়া। এখন তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী’। জীবনের শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এই কিশোরীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয় উখিয়ার কুতুপালংয়ের টিভি রিলে স্টেশনের পাশে সড়ক-লাগোয়া একটি ক্যাম্পের সামনে। এখানে এরকম লাখো কিশোরী রয়েছে, যাদের সামনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। মিয়ানমারের আনজুমান পাড়া থেকে সাত দিনে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে শওকত আরা (১১)।  সে জানায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর তারা এপারে এসেছে। বাবা অসুস্থ অথচ তাঁবুতে রয়েছে বাবাসহ মোট ৭ জন। সে স্কুলে না গেলেও নিয়মিত মক্তবে পড়তে যেত। মক্তবে তার ৫-৬ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। এখন তারা কে কোথায় জানে না সে। এখানে কোনো খেলাধুলা নেই। জীবন বাঁচাতে ত্রাণের জন্য তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে বলেও জানায় সে। নাইচং থেকে আসা ফাতেমা বেগম (১২) জানায়, সে চার ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। তাদের বাড়িঘর যখন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন সবকিছুর আগে তার বইগুলোর কথা মনে পড়ে।

 পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এপারে পালিয়ে এলেও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূর বেগমের কথা সে ভুলতে পারছে না। তারা পালিয়ে আসতে পারল কিনা তাও সে জানে না। এলেও কোথায় কোন ক্যাম্পের কোন তাঁবুতে তাদের আশ্রয় হয়েছে তা জানা আরও কঠিন বলে মনে করছে সে। তাদের দুজনেরই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তারা রোহিঙ্গা জাতির কল্যাণে কাজ করবে। কিন্তু ২৪ আগস্ট শুরু হওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের তাণ্ডবে সে স্বপ্ন এখন ভেঙে গেছে।

সাহেব বাজারের ইয়াসমিন আরা (১১) পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে। পাশাপাশি মক্তবেও যাওয়া হতো তার। পাড়ায়, স্কুলে-মক্তবে বেশ হৈহুল্লোড় করেই সময় কাটত তার। ছিল ১০-১২ জনের একটি বন্ধু বা সহপাঠীর দল। ব্যবসায়ী পিতার ঘরে জন্ম নেওয়া এই কিশোরীর স্বপ্ন ছিল সে বড় হয়ে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। যেহেতু তার দেশে ‘রোহিঙ্গা’দের জন্য উচ্চশিক্ষা অর্জনের কোনো সুযোগ ছিল না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর