‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে অপরাধ এবং নিষিদ্ধের ঘোষণা নিয়ে ভারতে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দির্ঘদিন ধরেই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার দাবি উঠছে। তবে দেশটির সরকার এবার এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করলো।
সি এন এন এর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভারতের সরকার বলছে, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে অপরাধ ঘোষণা করাটা অত্যন্ত কঠিন একটি সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশটিতে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে।
ভারতের আইন অনুযায়ী, স্ত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি ১৮ বছরের উপরের বয়সের হয় তাহলে সেটা বৈবাহিক ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো আইন ধরে রেখেছে দেশটি। যদিও যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ইতিমধ্যে আইনটি সংশোধন করেছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্য বৈবাহিক ধর্ষণকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব কটিতেই এটি অবৈধ।
প্রায় ৪০টি দেশে এখনো ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’–বিরোধী কোনো আইন নেই। এছাড়াও যে দেশগুলোতে এই ধরণের ধর্ষণ বিরোধী আইন আছে সেখানেও শাস্তির পরিমান খুব কম বলে জানা গেছে জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ডের ২০২১ সালের স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউতে।
যদিও যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য স্ত্রীর ওপর জোরজবরদস্তি করার দায়ে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এ ধরনের অপরাধকে ধর্ষণ বিবেচনা করলে এবং এক্ষেত্রে সাজা দেওয়া হলে সেটা ‘দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর গুরুতর প্রভাব’ পড়বে এমনকি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির ওপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে ভারতের শীর্ষ আদালতে এ–সংক্রান্ত আবেদনের ওপর শুনানি চলছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব আবেদনের বিরোধিতা করছে ভারত সরকার।
এক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করাটা অতিমাত্রায় কঠোর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছে ভারত সরকার। সরকার লিখিত হলফনামার মাধ্যমেও এ বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বিবেচনার পক্ষে সোচ্চার থাকা মানুষেরা বলছেন, সরকারের যুক্তি অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক এবং খুব একটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। তবে এই মতবাদ নারীর জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ফৌজদারি আদালতের বিচারপতি নাতাশা ভারদ্বাজ বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়াকে আমরা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছি।’
এর আগে জুলাইতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার দেশটির ১৬৪ বছরের পুরোনো দণ্ডবিধি বাতিল করে নতুন ফৌজদারি আইন চালু করেছে। তবে বৈবাহিক ধর্ষণবিরোধী আইন প্রণয়নের বিষয়টি কাগজে–কলমেই রয়ে গেছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার এমন এক সময়ে বৈবাহিক ধর্ষণের পক্ষে নিজেদের অবস্থান দাঁড় করালো, যখন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এক নবীন চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলন চলছে।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণা করার বিষয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য
দাম্পত্য সম্পর্কে নারীর সম্মতির বিষয়টি সুরক্ষিত থাকতে হবে। তবে স্বামী-স্ত্রী যে কারও একে অপরের প্রতি যৌক্তিক যৌন চাহিদা থাকতে পারে। যদিও সে আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে কেউ তাঁর স্ত্রীকে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করার অধিকার রাখেন না। তবে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ও বাইরে এ ধরনের আচরণের শাস্তি এক হতে পারে না।
ভারত সরকারের দাবি, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সম্মতির বিষয়টি সুরক্ষিত রাখতে যৌন ও পারিবারিক সহিংসতাবিরোধী প্রচলিত আইনগুলোই যথেষ্ট।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদন জানান মারিয়াম ধাওয়ালে। তিনি মনে করেন, বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে কিংবা বাইরে—দুই ক্ষেত্রেই সম্মতি কোনো আলাদা বিষয় নয়। সম্মতি সম্মতিই। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের স্বাধীন মানুষ হিসেবে, স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ভাবা হয় না। তিনি স্বামীর কাছে একধরনের অনুষঙ্গের মতো। তিনি অধস্তন, তাঁর তেমন করে আলাদা কোনো পরিচিতি থাকে না।’
ধাওয়ালে আরও বলেন, সহিংসতার শিকার হয়ে যেসব নারী তাঁর সংগঠনের কাছে সহযোগিতা চাইতে আসেন, সেসব সহিংসতার অনেকগুলোই বৈবাহিক ধর্ষণের। তবে প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা তাঁদের অভিযোগগুলো জানাতে চান না। কারণ, তাঁরা জানেন, কেউ তাঁদের বিশ্বাস করবেন না।
ধর্ষণের শিকার নারীদের ভাষ্য
গত মে মাসে মধ্যপ্রদেশের একজন বিচারপতি স্বামীর বিরুদ্ধে এক নারীর করা অভিযোগ খারিজ করে দেন। ওই নারী অভিযোগ করেছিলেন, স্বামী তাঁর সঙ্গে ‘অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক’ স্থাপন করেছেন। তখন বিচারপতি দেশটির আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বিচারপতি বলেন, এসব ক্ষেত্রে ‘স্ত্রীর সম্মতির বিষয়টি অমূলক হয়ে পড়েছে।’
নিপীড়নের শিকার হওয়া আরেক নারী এর আগে সিএনএনকে বলেন, তিনি মনে করেন, বাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে বিবেচনা করা উচিত। এতে নারীরা শক্তি পাবেন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে দাঁড়াতে পারবেন।’
অন্য এক নারী বলেন, তিনি স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে ভয় পান। কারণ, তিন সন্তানের ভরণপোষণের উপায় তাঁর নেই। তিনি মনে করেন, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণা করা হলে তাঁর মতো যেসব নারীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরা উপকৃত হতেন।
২০১৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সম্মতি নেওয়ার বিষয়ে দাম্পত্যসঙ্গীর বয়সসীমা ১৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৮ বছর করেন। অর্থাৎ, ১৮ বছরের কম বয়সী স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। আগে তা ১৫ বছরে সীমাবদ্ধ ছিল।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জায়না কোঠারি সিএনএনকে বলেন, ওই সময়েও ভারত সরকার একই যুক্তি দেখিয়েছিল। সম্মতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা বাড়ানোর বিরোধিতা করে তারা বলেছিল, এতে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান হুমকিতে পড়বে। তবে সুপ্রিম কোর্ট তা আমলে নেননি।
তবে এই আইন পাশ হলে আশঙ্কা দুই পক্ষেরই যে, নারীরা তাঁদের স্বামীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করতে পারেন।
তবে আইনজীবী কোঠারি তা মনে করেন না। তাঁর মতে, যৌন নিপীড়নবিরোধী আইন প্রচলিত থাকার পরও নারী ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানাতে কাঠখড় পোহাতে হয়। বৈবাহিক ধর্ষণবিরোধী আইন পাস হলেই যে তাঁরা সহজে অভিযোগ জানিয়ে সুবিধা আদায় করতে পারবেন, বিষয়টা এমন নয়।
সোর্সঃ সিএনএন
বিডি প্রতিদিন/ আশিক