অবৈধ সম্পদের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করতেই এক দিনের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে নিজেদের অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে নেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানরা। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে দাখিলের জন্য প্রস্তুত করা দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা এক দিনেই তাদের প্রায় সব অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করেন। তাদের নামে মোট ১১৬টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে অনেক অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। ৫ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট তথ্য- উপাত্তসহ মোট ৪২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন হাতে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য গত ১৮ এপ্রিল তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ১৯ ও ২০ এপ্রিল সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এই কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করে ২১ এপ্রিল।
এদিকে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বেনজীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু এবং দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের আদেশের দিনই বেনজীর আহমেদ-ও তার স্ত্রী-সন্তানরা বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের ১১৬টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে অন্তত ৪০টি অ্যাকাউন্ট থেকে অর্ধশত কোটি টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে কমিউনিটি ব্যাংক করপোরেট শাখায় বেনজীর আহমেদ তার অ্যাকাউন্ট (নম্বর-১০১৬০০০৮২০১) থেকে ৩ কোটি ৩ লাখ ২ হাজার ৮১২ টাকা তুলেছেন। তার স্ত্রী জিশান মির্জা একই শাখার অ্যাকাউন্ট (নম্বর- ১০৩০৫৭৩৯২০১) থেকে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ১৪ টাকা উঠিয়ে নেন। তাদের মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর তুলে নেন ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৮৮৬ টাকা।
এরপর দুদকের অনুসন্ধানকারী দল বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের অর্থসম্পদের তথ্য চেয়ে ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজউক, বিভিন্ন ভূমি অফিস, সাব- রেজিস্ট্রি অফিসসহ ৪৬টি দপ্তরে চিঠি পাঠায়। এরপর ২৯ ও ৩০ এপ্রিল বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানরা তাদের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন ও বিদেশে পাঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২৯ এপ্রিল সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিস থেকে বেনজীর আহমেদ ০০০২৬০২০০৫৬৫৮ অ্যাকাউন্ট থেকে বহির্গামী লেনদেন নিষ্পত্তির (আউটওয়ার্ড ক্লিয়ারিং) মাধ্যমে মোট ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা পাচার করেন। এ ছাড়া ৩০ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের একই শাখা থেকে নগদ আরও ১৪ লাখ টাকা ওঠানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা এবং তাদের মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর ও নাবালিকা মেয়ে যাইরা যারীন বিনতে বেনজীরের মালিকানায় জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, রিসোর্ট, বাংলোসহ বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাদের নামে চলতি, সঞ্চয়ী, স্থায়ী আমানত, বৈদেশিক মুদ্রাসংক্রান্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে ১১৬টি। এসব অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। অনুসন্ধান শুরুর পর দ্রুততম সময়ে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা ওঠানো হয়েছে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত পূর্ণ ও আংশিক মালিকানাধীন কয়েকটি কোম্পানি পাওয়া গেছে। যেগুলোতে কোটি কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। একাধিক ব্রোকারেজ হাউসে তাদের নামে বেশ কয়েকটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট ও তাতে অনেক লেনদেন পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে আরও বলা হয়, দলিলে উল্লেখ করা মূল্য অনুযায়ী বেনজীর আহমেদের ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা, তার স্ত্রী জিশান মির্জার ২১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা, মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীরের ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। নিরপেক্ষ প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে এসব জমির মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এসব সম্পদের মূল্য বহুগুণ বাড়বে। এ ছাড়া দলিলে বেনজীর আহমেদের নামে বান্দরবানে ২৫ একর জমি, মুন্সীগঞ্জে ১৪ কাঠার দুটি প্লট, তার স্ত্রী জিশান মির্জার নামে উত্তরায় বিলাসবহুল ৭ তলা বাড়ি, আদাবরে পিসিকালচার হাউজিংয়ে ৬টি ফ্ল্যাটের কোনো মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি।
এসব সম্পত্তি লিজ ও অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা দেখানো হয়েছে। এসব সম্পত্তিরও মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। এসব অর্থসম্পদ আদালতের নির্দেশে ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়েছে। সেগুলোতে রিসিভার নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের আয়কর নথি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের নামে-বেনামে ও বিদেশে থাকা অর্থসম্পদেরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের দুই দফা তলব করা হলেও তারা হাজির হননি। ছোট মেয়ে যাইরা যারীন নাবালক হওয়ায় তাকে তলব ও সম্পদের নোটিশ পাঠানো হয়নি। প্রতিবেদনের ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নম্বর ৪৪২৫/২০২৪ সংশ্লেষে ২৩ এপ্রিলের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য পাঠানো হলো। প্রতিবেদনটি দিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক (মানি 'লন্ডারিং) মো. আনোয়ার হোসেন। বর্তমানে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদন আগামী রবিবার অথবা সোমবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবেও দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন।