রাজধানীর এক সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং জমজমাট সবুজ উদ্যান পান্থকুঞ্জ পার্ক এখন উন্নয়নের বলি হয়ে অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প পার্কের মধ্যে নামার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ পার্কটিও। এর প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে শহীদ আনোয়ারা পার্কেরও অভিন্ন অবস্থা। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের ৬ নম্বর লাইনের স্টেশন ও অফিস নির্মাণের কারণে সেই পার্কেরও মরণ দশা হয়েছে। এখন সেখানে পার্কের কোনো অস্তিত্ব নেই। পান্থকুঞ্জ পার্কের অধিকাংশ গাছ কেটে সেখানে রাখা হয়েছে ইটপাথরসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। চারপাশে জমে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। একাংশে গড়ে তোলা হয়েছে বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র-সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন-এসটিএস। এক কোণে আছে রিকশা ও ভ্যানগাড়ির গ্যারেজও। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল মোড়ের এ পার্কের করুণ দৃশ্য দেখে হাহাকার করে ওঠেন পাশ দিয়ে চলাচলকারী প্রতিদিনের লাখ লাখ যাত্রী-পথচারী।
পার্কগুলোর এক সময় নগরবাসীর স্বাস্থকেন্দ্র হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল। পরবর্তীতে দখল-দূষণ এবং উন্নয়নের কারণে অধিকাংশ পার্কই এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। রাজধানীর বাংলমোটরসংলগ্ন ত্রিভুজাকৃতির পান্থকুঞ্জ পার্কটি কয়েক বছর আগেও বেশ দৃষ্টিনন্দন ছিল। স্থানীয় প্রবীণরা পার্কটিতে সকাল-বিকাল হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করতেন। তপ্ত দুপুরে গাছের সবুজ ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিতেন পথচারীরা। কয়েক বছরের ব্যবধানে ছোট উদ্যানটি এখন বেহাল দশায় পড়েছে। উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে রয়েছে পার্কটি। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থানের অভাবে ইতোমধ্যে রুদ্ধশ্বাস ঢাকায় এমন একটি পার্ককে অবহেলায় ধ্বংস করে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পরিবেশ সংরক্ষণ করেই বিকল্প পদ্ধতিতে উন্নয়ন করতে হবে।
পান্থকুঞ্জ পার্ক এখন বিরানভূমির মতো। অধিকাংশ গাছ কেটে সেখানে রাখা হয়েছে ইটপাথরসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি করে উন্মুক্ত জায়গা সংকুচিত করা হয়েছে। পান্থকুঞ্জ পার্কটি কার্যত নষ্ট হওয়া শুরু হয় ২০১৮ সালে। তখন ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ (ডিএসসিসি) ‘জলসবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় এর জন্য ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, এক বছরের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ হলে পার্কটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার মাটি খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়া পার্কটিতে তেমন কোনো কাজ করেননি। পরে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলার সময় পার্কের বড় অংশে অনেক নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়। এখন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি সংযোগ সড়ক পান্থকুঞ্জ পার্কে নামাতে কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিকরা।
সরেজমিন পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা পার্কের চারপাশে ময়লা-আবর্জনা। ভিতরে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা আছে। পার্কের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। দক্ষিণ অংশে পার্কটির কিছু জায়গায় বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস), টয়লেট ও ওয়াসার একটি পানির পাম্প। পার্কের ভিতরে দেখা যায়, রিকশা ও ভ্যানগাড়ির গ্যারেজ, ভাসমান মানুষের আনাগোনা। প্রায় তিন বছর ধরে পার্কের ভিতরে রিকশা ভ্যানের গ্যারেজ রয়েছে। পার্কটির ওই অংশে বাচ্চারা খেলাধুলা করত, বয়স্করা আড্ডা দিত।
কাঁঠালবাগানের ব্যবসায়ী মীর রফিকুল ইসলাম বলেন, এ পার্কটিকে ঘিরে আমাদের অনেক আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি রয়েছে। পান্থকুঞ্জকে আবার কোনো দিন আগের মতো পাব কি না, জানি না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা কী জবাব দেব। পার্কটি রক্ষার ব্যাপারে কারও কোনো উদ্যোগই নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জলসবুজে ঢাকা প্রকল্পের আওতায় পার্কটির উন্নয়ন করার কথা ছিল। তখন সেভাবে ডিজাইন করা হয়। পরে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ ও এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়কের কারণে পার্কের ডিজাইন নতুন করে করা হয়। এখন পার্কটি কোন অবস্থায় আছে ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ বলতে পারবে। ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেছেন, তাঁর কাছে পার্কের সর্বশেষ অবস্থার তথ্য নেই। তিনি পরে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন।
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পান্থকুঞ্জ হচ্ছে ওই এলাকার আশপাশের মানুষের জন্য একমাত্র পার্ক। মেগা প্রজেক্টের নাম দিয়ে একে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ ও এক্সপ্রেসওয়ের নাম দিয়ে পার্কটি ধ্বংস করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।