শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ইসলাম প্রচারে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

মোস্তফা কাজল

ইসলাম প্রচারে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

মহান দয়ালু আল্লাহতায়ালা মানুষের কল্যাণে এবং সত্য পথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে নবী ও রসুলগণকে এ ধরাপৃষ্ঠে পাঠিয়েছিলেন। যখন নবী-রসুলগণ উম্মতদের রেখে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান, তখন তারা পরকালের কথা ভুলে, নবীদের কথা ভুলে দুনিয়ামুখী হয়ে পড়েন। শুরু করেন নানা ধরনের অপকর্ম। যে যুগটাকে এখনো মানুষ আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ বলে। জাহেল অর্থ অন্ধকার। যে যুগে মানুষ ইসলাম তথা আলোর পথ ভুলে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, সেই জাহেলি (অন্ধকার) যুগে আরবরা কন্যাসন্তানকে হত্যা করত, এমনকি জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। অনাথ শিশুদের দয়া-মায়া দেখানো হতো না। কাঠ ও পাথরের প্রতিমা বানিয়ে পূজা করত। কোনো মহিলা চারিত্রিক সততার পরিপন্থী কোনো কাজ করলেই তার মোহরানা সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যেত। মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা নিজেদের স্ত্রীদের ওপর অপবাদ আরোপ করত। ওই অন্ধকার যুগের জাহেলিয়াত দূর করতে সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল হিসেবে মহান আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব।  জন্মের আগেই মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পিতাকে হারিয়ে এতিম হয়েছিলেন।

 

নবীজির শিশুকাল

তৎকালীন আরবের রীতি ছিল, যে কোনো শিশু জন্মগ্রহণের পর মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। অনেকে নিজ নিজ সন্তানের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়নের জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিতেন। নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে মুহাম্মদ (সা.) কেও বিবি হালিমা সাদিয়া নামে এক মহিলার হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি দুধমা হিসেবে পরিচিতি পান। শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে ঘরে আনার পর দেখা যায়, বিবি হালিমার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। শিশু মুহাম্মদ (সা.) কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন। অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালন-পালনের পর দুধমা হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে নিজের মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু কিছু দিন পর পুরো মক্কাজুড়ে আকস্মিক মহামারী দেখা দেয়। ফলে মা আমিনা নিজে যতœবান হতে পারবেন না জেনে পুনরায় শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেন। এদিকে বিবি হালিমাও মনে মনে চাচ্ছিলেন শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে আবার ফিরে পেতে। এতে তাঁর আশা পূর্ণ হলো। ইসলামী বিশ্বাস মতে, কয়েক দিন পর একটি কালজয়ী অলৌকিক ঘটনা ঘটে তাঁর সঙ্গে। একদিন বিবি হালিমার পুত্র ও শিশু মুহাম্মদ (সা.) মাঠে মেষ চরাচ্ছেন। এতে কয়েকজন মিলে খেলছেন। কিন্তু শিশু মুহাম্মদ খেলছেন না। বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর অপরিচিত কয়েকজন লোক এসে শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে জমিনে শুইয়ে বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেন। তা দেখে অন্য শিশুরা ভয়ে দৌড়ে গিয়ে পুরো ঘটনা হালিমা সাদিয়াকে বলল। সঙ্গে সঙ্গে হজরত হালিমা (রা.) ঘটনাস্থলে পৌঁছান। কিন্তু এসেই দেখেন শিশু মুহাম্মদ (সা.) সুস্থভাবে বসে আছেন। এ ঘটনার পরই হজরত হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের সঙ্গে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদিনায় যাবেন। মা আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছেন। তিনি মদিনায় এক মাস অতিবাহিত করেন। এক মাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ধীরে ধীরে মক্কায় পৌঁছেন। এরপর থেকে দাদাই মুহাম্মদ (সা.)-এর দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তাঁর দাদাও মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পুত্র আবু তালিবকে ডেকে নাতি শিশু মুহাম্মদের দায়িত্বভার দিয়ে যান। চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন। আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সঙ্গে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রচ- মমতার কারণে চাচা আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। তখন আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। শহরটিতে জারজিস নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রি ছিলেন। তিনি তার গির্জা থেকে বাইরে এসে মুসাফিরদের মেহমানদারি করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মদ (সা.) কে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফুজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিল না।

এ ছাড়া মক্কা থেকে মদিনায় ইতিহাসখ্যাত হিজরতের মাত্র তিন বছর আগে বিবি খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল হয়। এ সময় নবী করিম (সা.)-এর বয়স ছিল ৪৯ বছর। হজরত খাদিজা (রা.)-এর  মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নবীজি (সা.)-এর একমাত্র স্ত্রী।

 

ইসলাম প্রচার

মহানবী (সা.) বুঝতে পারেন, ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভিত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোনো উপায় ছিল না। মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)। এরপর মুসলমান হন মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, তাঁর ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী (রা.)। হজরত আলী (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের সময় বয়স ছিল ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী (সা.) নিজ বংশীয় বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি সভা করেন। এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি। এ সভায় শুধু একজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হলেন হজরত আলী (রা.)। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন নবীর (সা.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু, মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ করতে থাকেন। এভাবে তিন বছর গোপনে দীন ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসার শুরু করেন। এ ধরনের প্রচারের সূচনাটা নাটকীয় ছিল। নবী (সা.) সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন, আল্লাহতায়ালা ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহতায়ালার  প্রেরিত রসুল। এ সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়। মক্কার কাফির-মুশরিকরা যখন নবী করিম (সা.) কে আদর্শিক দিক দিয়ে মোকাবিলা করতে পারছিল না, তখন তারা কুৎসা রটনাসহ অশালীন কথা দ্বারা মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপনের ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। তাদের বিশ্বাস, এই অস্ত্রের আঘাতেই তাকে ধরাশায়ী করা যাবে। ভিনদেশি লোকেরা দীন গ্রহণ করতে এসে তাঁর বদনাম শুনে ইসলাম গ্রহণ না করে নিজ দেশে ফিরে যাবেন। আর যদি তারা যাচাই-বাছাই করতে আসেন, তাহলে ঘুরে-ফিরে তাদের কাছেই তো আসতে হবে। তখন তারা তাদের মগজধোলাই করে ছাড়বেন। কাফির-মুশরিক কর্তৃক রসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেওয়া গালি ও মিথ্যা অপবাদসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো। তারা রসুলুল্লাহ (সা.) কে পাগল বা কবি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। যেন মানুষ তাঁর কাছে না যান, তাঁর কাছে  প্রেরিত ওহি তথা কোরআনুল কারিম থেকে দূরে থাকেন। আরবে বসবাসকারী কতিপয় লোক নবী (সা.) কে সাধারণ মানুষ বলে তাঁর নবুয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। কেননা তিনি নবী হলে তাঁর সঙ্গে কোনো ফেরেশতা নেই কেন। যে তাঁর সত্যায়নকারী হতো? তারা মনে করত, নবী কোনো সাধারণ মানুষ হতে পারেন না। তিনি ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ একজন হবেন। এভাবে তারা পথভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও উল্টো তারাই নবী করিম (সা.) কে পথভ্রষ্ট বলে গালিগালাজ করতে লাগল। তাদের দৃষ্টিতে তারাই হকপন্থি। নবী করিম (সা.) ও মুমিনরাই বিপথগামী। রসুলুল্লাহ (সা.) কে বেদীন বা ধর্মত্যাগী বলে তাদের প্রচারণা চালাতেন। জাহেলি যুগের মানুষদের প্রচারণায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। ওই যুগে কুরাইশ নেতারা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের কাছে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ করে। এসব অভিযোগে ইসলামের দাওয়াতি মিশন নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিল। প্রকারান্তরে তারা নবী করিম (সা.) কে নিয়ে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা চাচার  কাছে অভিযোগ করে যে, আপনার ভাতিজা পিতা-পিতামহের বিরোধিতা করছে। আপনার জাতির ঐক্য ছিন্নভিন্ন করছে। তাঁদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। আমরা তাঁকে হত্যা করব। (আর-রাহিকুল মাখতুম, ১৭তম সংস্করণ ২০০৫ইং, পৃ. ৯৪)। এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হলো উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। মহানবী (সা.) সব সময় চাইতেন আবু জেহেল ও ওমর (রা.) এদের যে কোনো একজন ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর এই ইচ্ছা পূর্ণ হলো। আরবে ওমর (রা.)-এর বিশেষ প্রভাব থাকায় তাঁর ইসলাম গ্রহণে ইসলাম প্রচার অনেকটা সহজ হয়। পরে মহানবী (সা.)-এর চাচা হামজা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায়।

 

নবুয়ত

মুহাম্মদ (সা.) অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে, তাঁর উপাধি হয়ে যায় আল-আমিন এবং আল-সাদিক। বাংলায় অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী।

আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানত প্রবণতা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মদ (সা.) এতে যোগদান করেন। এই সংঘকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। জানা যায়, তরুণ বয়সে মুহাম্মদ (সা.)-এর তেমন কোনো পেশা ছিল না। তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। মুহাম্মদ (সা.) অল্প সময়ের মধ্যেই এই কাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে, তাঁর উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক। বাংলায় অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেছেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ অবহিত হন। পরে তাঁকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। যুবক মুহাম্মদ (সা.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার বসরায় যান। মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কাবা গৃহের পুনর্র্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনর্র্নির্মাণের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়, তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবেন তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণ কাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে। এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। চার-পাঁচ দিন ধরে এ বিবাদ অব্যাহত থাকে। একপর্যায়ে তা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। এমনকি হানাহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করেন। পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবেন তাঁর সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবেন। পরদিন মুহাম্মদ (সা.) সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হন। তাঁকে বিচারক হিসেবে মেনে নেন। এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার ওপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন। বিদ্যমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন। ৪০ বছর বয়সে নবী মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভ করেন। জুহরি বর্ণিত হাদিস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহি লাভ করেন। ৩০ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী করিম (সা.) মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) তাঁর কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহি নিয়ে আসেন। জিবরাইল তাঁকে এক পঙ্ক্তি (কোরআনের আয়াত, সুরা আলাক্ব-এর) পড়তে বলেন। যার অর্থÑ ‘পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। উত্তরে নবী জানান যে, তিনি পড়তে জানেন না। এতে জিবরাইল (আ.) তাঁকে জড়িয়ে ধরে মৃদু চাপ প্রয়োগ করেন। আবার একই পঙ্ক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মদ (সা.) নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) পঙ্ক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবতীর্ণ হয় পবিত্র কোরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ। সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী (সা.) ভীত হয়ে পড়েন। পরে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজা (রা.) কে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, ‘আমাকে আবৃত কর।’ তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ওহি আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সুরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এরপর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মদ (সা.)। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই নবী (সা.)-এর মক্কি জীবন শুরু হয়।

 

মক্কার বিরোধ ও যুদ্ধ

মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদিনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় এসে আশপাশের সব গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সব মুসলিমের সম্পত্তি ক্রোক করে। এ অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঠান। কারণ ওই কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক-তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই যুদ্ধে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতার মাধ্যমে মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেন। এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটে। এরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদিনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। কুরাইশরা প্রথমে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দুর্বলতার কারণে পরাজিতের বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদিনা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধবিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়।  ফলে আশপাশের অনেক গোত্রের ওপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

 

বিদায় হজ

দশম হিজরি। জিলহজ মাস। ২৩ বছর আগে হেরা গুহায় জ্বলে উঠেছিল সত্যের আলো। তা পূর্ণতায় উপনীত হয়েছে। এক কঠিন দায়িত্ব নিয়ে মোহাম্মদ (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন এ পৃথিবীতে। এত বছরের কঠিন পরিশ্রম, সংগ্রাম, অপরিসীম কোরবানি ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। তার সমাপ্তি হয়েছে। দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি সাধনা করে একটি রাষ্ট্র গঠন করলেন। গঠন করলেন শোষণমুক্ত জুলুমহীন ন্যায়বিচারের সমাজ। গড়ে তুললেন তৌহিদভিত্তিক নব সভ্যতার এক নতুন জাতি মুসলিম উম্মাহ। তাই নবী করিম (সা.) সঙ্গী-সাথীসহ পবিত্র হজের উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে গমন করেন। হজ সম্পাদন করেন। প্রতিবছর হজের সময় লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক। সেখানে দাঁড়িয়ে এক মুসলিম উম্মাহ গঠনের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন। মুসলমানরা মাকামে ইবরাহিমে সমবেত। ৯ জিলহজ রসুল (সা.) সব মানুষের সামনে দাঁড়ালেন। মহানবী (সা.) প্রথমে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করলেন। নবীজি (সা.) এক ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করলেন। তিনি বললেন, প্রিয় মুসলমানগণÑ এক. আজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং সকল প্রকার অনাচার দলিত-মথিত হয়ে গেল। দুই. তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের সঙ্গে তোমরা খারাপ ব্যবহার করবে না। তাদের ওপর নির্যাতন করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তোমরা তা-ই খেতে দেবে। তোমরা যে বস্ত্র পরিধান করবে, তাদেরকে তাই পরিধান করতে দেবে। মনে রেখ তারাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। এরাও একই আল্লাহর সৃষ্টি। তিন. সাবধান! নারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কখনো অন্যায়-অত্যাচার করবে না। কেননা তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপরই। তোমাদের যেমন নারীদের ওপর অধিকার আছে, তেমনি তোমাদের ওপরও নারীদের অধিকার আছে। দয়া ও ভালোবাসার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আচরণ করবে। চার. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে সে কুফুরি করল। পাঁচ. সুদ, ঘুষ, রক্তপাত, অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন করবে না। কারণ এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। আর মুসলমান পরস্পর ভ্রাতৃসমাজ। ছয়. তোমরা মিথ্যা বলো না। আর মিথ্যা সব পাপ কাজের মূল। কারণ মিথ্যাই বিপদ ডেকে আনে। সাত. চুরি করো না। ব্যভিচার করো না। পবিত্রভাবে জীবনযাপন করো। সাবধান! শয়তান থেকে তোমরা দূরে থেকো। তোমরা যে কোনো কাজকে সামান্য মনে করবে। সমাধান করবে। কিন্তু শয়তান এসবের মাধ্যমে তোমাদের সর্বনাশ করিয়ে ছাড়বে। আট. তোমরা তোমাদের আমিরের আদেশ অমান্য করবে না। তোমরা তাঁর আনুগত্য করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহর দীনের ওপর অটল থাকবে। নয়. ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা এই কারণে ধ্বংস হয়েছে। দশ. বংশের গৌরব করবে না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয়প্রতিপন্ন করে অপর বংশের পরিচয় দেয়, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। একাদশ. তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে। রোজা রাখবে, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে, তবেই তোমরা জান্নাতি হতে পারবে। দ্বাদশ. আমি আমার পরে তোমাদের জন্য যা রেখে যাচ্ছি তা তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে। তার ওপর আমল করবে। তা হলে তোমাদের পতন ঘটবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কোরআন ও নবীর সুন্নত। ত্রয়োদশ. তোমরা ভালোভাবে জেনে রাখো, আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমিই তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আমার সব বাণী তোমরা যারা শুনেছ তারা যারা অনুপস্থিত তাদের নিকট পৌঁছে দেবে। এভাবে মহানবী (সা.) তাঁর ভাষণ শেষ করলেন এবং তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে বললেন, আমি কি তোমার দীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখন তিনি আবার বললেন যে, ‘হে প্রভুু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন। এরা বলেছে, আমি আপনার দীনকে লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি। পরে নবী (সা.) নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তাঁর চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কোরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়। এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম। অতঃপর হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। সব সাহাবি নীরব। কিছুক্ষণ পর হজরত নবী করিম (সা.) জনতার দিকে তাকালেন। করুণ ও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন- বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়।

 

মক্কা বিজয় ও  তায়েফ গমন

স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও শাসননীতি প্রণয়নে মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিদ্যমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ নামে। তিনি সব গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর করেন।

তায়েফ গমন : তায়েফ গমনের বছরটি ছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য দুঃখের বছর। কারণ এ বছর খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) ও চাচা আবু তালিব মারা যান। পরে হতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান। কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদের মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেছনে লেলিয়ে দেন। তারা ইট-পাথরের আঘাতে নবী (সা.) কে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। মিরাজের ঘটনা : ইসলামী ভাষ্য মতে, এ সময় মুহাম্মদ (সা.) এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান। মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে ঊর্ধ্বারোহণ করেন। মহান স্র্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি বেহেশত ও দোজখসহ মহাবিশ্বের সব স্থান অবলোকন করেন। এ যাত্রা ইতিহাসে মিরাজ নামে পরিচিত। মদিনায় হিজরত ও মাদানি জীবন এরপর থেকে শুরু হয়। এ সময় আরও শুভ ঘটনা ঘটে। মদিনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মূলত হজ করতে এসে ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন। এরা আকাবা নামক স্থানে মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে শপথ করেন। তারা যে কোনো অবস্থায় নবী (সা.) কে রক্ষা করবেন। ইসলামের প্রসারে কাজ করবেন। এ শপথ ‘আকাবার শপথ’ নামে সুপরিচিত। এ শপথের মাধ্যমেই মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এক সময় মদিনার ১২টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদিনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গেত্রে গোত্রে এবং ইহুদিদের সঙ্গে অন্যদের যুদ্ধ লেগেই থাকে। মদিনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেওয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারে না। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যিনি সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবেন। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মদ (সা.) কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। এ আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যান। সবশেষে মুহাম্মদ (সা.) ও আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এভাবেই মক্কা যুগের সমাপ্তি ঘটে।

মক্কা বিজয় : ১০ বছর মেয়াদি হুদাইবিয়ার সন্ধি মাত্র দুই বছর পরেই ভেঙে যায়। খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র। অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। এক রাতে বকর গোত্র খুযাআহদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কুরাইশরা এ আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। এ ঘটনার পর মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র প্রেরণ করেন। কুরাইশদের এ তিনটি শর্তের যে কোনো একটি মেনে নিতে বলেন। শর্ত তিনটি হলোÑ কুরাইশরা খুযাআহ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে অথবা তারা বকর গোত্রের সঙ্গে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে। অথবা এ ঘোষণা দেবে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে। কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। উত্তরে কুরাইশরা জানাল যে, তারা শুধু তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবেন। কিন্তু খুব দ্রুত কুরাইশরা তাদের ভুল বুঝতে পারলেন। আবু সুফিয়ানকে সন্ধি নবায়নের জন্য দূত হিসেবে মদিনায় প্রেরণ করলেন। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করলেন।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.) ১০ হাজার সাহাবির বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওনা হলেন। সেদিন ছিল অষ্টম হিজরির রমজান মাসের ১০ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজয় হলো। মুহাম্মদ (সা.) বিজয়ীর বেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। মক্কায় প্রবেশ করেই মুহাম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন। পরে সেখানকার সব মূর্তি ধ্বংস করেন। মুসলমানদের শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষমা গুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করেন।

নবীজি (সা.)-এর ওফাত : বিদায় হজ থেকে ফেরার পর হিজরি ১১ সালের সফর মাসে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচ- হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি ১১ দিন নামাজের ইমামতি করেন। ধীরে ধীরে অসুস্থতা তীব্র হওয়ায় তিনি হজরত আবু বকর (রা.) কে ইমামতি করার জন্য নির্দেশ দেন। আবু বকর (রা.) নবীজির (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রায় অনেক দিন নামাজে ইমামতি করেন। অবশেষে হিজরি ১১ সনের ১২ রবিউল আউয়াল সন্ধ্যায় তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হজরত আয়েশা (রা.)-এর কামরার যে স্থানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জানাজার পর সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।

সর্বশেষ খবর