ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের জ্বালানি খাতে। বিশ্বের অন্যতম সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেলের আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র হওয়ায় এলএনজির সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং গত সপ্তাহেই এশিয়ার স্পট মার্কেটে এ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্থিরতা বাড়তে থাকলে আসছে দিনে দেশে জ্বালানির দামেও প্রভাব পড়তে পারে বলে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় হুমকির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাব পড়বে শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি ও খুচরা বাজারে। এতে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ভোক্তাপর্যায়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।
বর্তমানে দেশের গ্যাসের চাহিদার ৩০ শতাংশের বেশি পূরণ হচ্ছে এলএনজি দিয়ে। আসছে দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এলএনজির দাম আরও অস্থিতিশীল হতে পারে বলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। মূলত ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতার কারণে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশে গ্যাসসংকট আরও বড় আকারে তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সূত্র জানায়, দেশে দিন দিন সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের জোগান কমছে। এ অবস্থায় এলএনজি সরবরাহ আরও কমলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আবাসিক, বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতে। এরই মধ্যে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এলএনজি সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ায় দেশজুড়ে তীব্র গ্যাসসংকটে দুর্ভোগে পড়েন গ্রাহকরা। মূলত দেশে আসা এলএনজির পুরোটাই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যার বেশির ভাগ আসে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি করে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। কাজেই ইরান এটি বন্ধ করলে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এজন্য সংঘাত দীর্ঘ হলে এলএনজি আমদানি সরকারের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।
জ্বালানি বিভাগ চলতি বছর মোট ১১৫টি এলএনজি কার্গো জাহাজ আনার অনুমোদন দিয়েছে। তবে আবহাওয়া ও টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণের বিবেচনায় ১০৯টি জাহাজ আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী ওমান ও কাতার থেকে ৫৬টি এলএনজি কার্গো আসার কথা। এর মধ্যে ২৩টি কার্গো এসেছে। বাকি ৩৩টি কার্গো বছরের অবশিষ্ট সময়ে আসার কথা। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আবুধাবি হয়ে বিকল্প পথে এ জাহাজ আনতে হবে। তখন পরিবহন খরচও বেড়ে যাবে। তবে সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়লে ওমান ও কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করা কঠিন হয়ে যাবে। এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সর্বোচ্চ ৩৬ ডলারে এলএনজি কিনেছিল বাংলাদেশ। সে বছর বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ৬০ ডলারে ওঠে। ডলারসংকটে সে সময় জুলাই থেকে টানা সাত মাস খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয় বন্ধ রাখে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে গ্যাসসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায়। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জ্বালানি খাতে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব কিছুটা থাকবেই। এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোর বড় অংশে কাতার থেকে এলএনজি আসে। কোনো কারণে যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এ সোর্সিংটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর এলএনজি সমুদ্রপথ ছাড়া অন্য আর কোনোভাবে আমদানি করা যাবে না। একই সঙ্গে এ যুদ্ধের কারণে এ জ্বালানির দামও বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে এলএনজির দাম অস্থিতিশীল হয়েছে। এর দাম বাড়ছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবহন করা হয়। এই প্রণালি সাময়িকভাবে বন্ধ হলে আন্তর্জাতিকভাবে বাজারে তেলের দাম এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাবে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের জাহাজ ভাড়া বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যদিও এরই মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেছেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আপাতত পর্যবেক্ষণ করছি। যুদ্ধটা বেশি দিন চললে আমাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি সচিবালয়ে ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি সার, জাহাজ চলাচলেও প্রভাব পড়তে পারে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে যে জাহাজ আসে তাতে প্রভাব পড়তে পারে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মো. রফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আমরা বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছি। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। জিটুজি এবং প্রাইভেট অকশনের মাধ্যমে যে দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের এলএনজি ও তেল আমদানির চুক্তি হয়েছে তাদের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে যে, জুন ও জুলাইয়ের মধ্যে যে জ্বালানি আমদানি করার কথা তা যেন দ্রুত ভর্তি করে হরমুজ প্রণালি পার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু কাজ এগিয়ে গেছে। আমাদের সাধ্যের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যতটা করা যায় করছি।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল