ঈশিতা রানী। পেশায় গৃহিণী। স্বামী পরিমল চন্দ্র কাজ করেন দিনমজুরের। দুই সন্তানসহ চার সদস্যের টানাপোড়েন এক সংসার। একমাত্র স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে চোখে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে ঈশিতা রানীর। অভাব এবং হতাশার হাতছানিকে উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। স্বামীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ২০০১ সালে হাঁস পালন করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন ঈশিতা।
জানা যায়, ঈশিতা রানীর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউনিয়নের মুসল্লি পাড়া গ্রামে। বাড়ির চারপাশে বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন শুরু করেন ঈশিতা। এর জন্য আলাদা কোনো ঘরের প্রয়োজন হয়নি। বাড়তি কোনো খাবারেরও প্রয়োজন হয়নি। বিলের কিনারায় নেট জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে সেখানে হাঁস রাখেন। পাশেই রয়েছে বাঁশের চাটাই এবং পলিথিনে ঘেরা আরেকটি টং ঘর। সেখানে রাতে হাঁস পাহাড়া দেয় ঈশিতা এবং তার স্বামী পরিমল। একদিকে স্বামীর সংসারের ঘানি, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী উদ্যোক্তা ঈশিতা। অভাবকে জয় করে সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা। তার এই প্রচেষ্টা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প দেখে এলাকার অনেকেই ঝুঁকছেন হাঁস পালনের দিকে।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার ধালাপাড়া সাগরদিঘী সড়কের ঘোড়াধহ সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গিছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। সামনেই মুসল্লিপাড়া গ্রাম। গ্রামটি নিচু এলাকা হওয়ায় প্রায় সারাবছর পানি থাকে। গ্রামটির নাম মুসল্লিপাড়া হলেও এখানে বাস করে ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ গ্রামেই বাস করেন ঈশিতা রানী।
ঈশিতা রনী বলেন, আমি ২০০১ সাল থেকে কিছু হাঁস লালন-পালন করি। তারপর ধারদেনা করে ৫০টি হাসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করি ছোট একটি খামার। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারদেনা সব পরিশোধ করেছি। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা এবং লাভের জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে চলতি বছর আমার খামারে ৩০ টাকা দরে ৫০০ হাঁসের বাচ্চা তুলেছিলাম। সবগুলোই দেশি হাস। বর্তমানে আমার খামারে প্রায় ৪০০ হাঁস ডিম দিচ্ছে। কিছু হাঁস মারা গিছে। বাকিগুলো পুরুষ হাঁস। হাঁসের ডিমের বাজার ভালো থাকায় প্রতিদিন ডিম বিক্রি করে আয় হচ্ছে প্রায় চার হাজার টাকা। এতে আমার মাসে আয় হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। সারাদিন হাঁসগুলো উন্মুক্ত জলাশয়ে খাবার খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খামারে চলে আসে। ডিম পাড়ার সময়ে দুপুরে বাড়তি খাবার হিসেবে ধানের কুড়া দিতে হয়। মাঝে মাঝে হাঁসের ছোটখাটো রোগবালাই হলে ওষুধ দিতে হয়। তাছাড়া আমার খামারে অন্য কোনো খরচ নেই। বাড়ির আশপাশের লোকজন ধান ভাঙায়, চাল থেকে যে কুড়া বের হয়, সেগুলো আমি পরিষ্কার করে দেই, বিনিময়ে তারা আমাকে কুড়াগুলো দেয়। বাইরের কোনো ওষুধ ও খাবার না খাইয়ে নিজস্ব প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে আমি হাঁস লালন-পালন করছি। এতে করে আমার খামারের হাঁস সুস্থ ও ভালো থাকে। চাহিদা ভালো থাকায় ডিমগুলো বাজারে নিতে হয় না। খামারে এসে পাইকার ডিম নিয়ে যাচ্ছে। এতে দামও ভালো পাচ্ছি। আবার ডিম পাড়া শেষ হলে ও হাঁসের বয়স হলে প্রতিটি হাঁস ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে দেই। হাঁস বিক্রি করেও প্রাই দুই লাখ টাকার মতো আয় করতো পারবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সংসারে আগে যেমন অভাব-অনটন ছিল বর্তমানে তা আর নেই। আমার দুই সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছোট ছেলের বয়স ৪ বছর। মেয়ের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের খরচ করে যে টাকা থাকে সেগুলো সঞ্চয় করি। পরিবার নিয়ে বর্তমানে সুন্দরভাবে চলতে পারছি। আমার দেখাদেখি আমাদের এলাকার আরও লোকজন হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ঘাটাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বাহাউদ্দীন সারোয়ার রিজভী বলেন, ঈশিতা রানী উপজেলার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমরা আশা করছি তার সফলতা দেখে এ উপজেলার অন্যান্য নারী-পুরুষ অনুপ্রাণিত হয়ে খামারি হয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দপ্তর থেকে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা তাদের ফ্রিতে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এ ছাড়াও সরকারি নির্ধারিত মূল্যে হাঁসের ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি।
বিডি প্রতিদিন/এমআই