বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই কঠিনেরে ভালোবাসা

আবু তাহের, নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সেই কঠিনেরে ভালোবাসা

ভয়ানক ক্যু-দেতা করে সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট স্যামুয়েল ক্যানিয়ন ডো ১৯৮৬’র ৬ জানুয়ারি উৎখাত করেছিলেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টোলবার্টকে। টোলবার্ট ও তাঁর ১৫ মন্ত্রীকে সাগরসৈকতে নিয়ে গুলি করা হয়। ডো অনুগত সৈন্যরা মৃতদেহগুলোর ওপর পা রেখে ফটোগ্রাফের জন্য পোজ দেয়; কুৎসিত সেসব ছবি পত্রিকার পাতায় দেখে শিউরে ওঠে মানুষ।  মাস নয়েক পরে পশ্চিমী এক সাংবাদিক জানতে চান, ‘ক্ষমতাসীন হওয়ায় ব্যাপারটি কেমন উপভোগ করছেন স্যার?’ জবাবে স্যামুয়েল ডো বলেন, ‘ইজি টু কংকার, হার্ড টু রুল’ (অর্জন সহজ, শাসন কঠিন)।

বার্তা সম্পাদক পদে আমার ওঠা সহজ ছিল না। ওই পদে বসে কাজ চালানো? হ্যাঁ, বেশ কঠিনই ছিল। তবে সেই কঠিনেরে আমি ভালোবেসেছিলাম। নেশার মতোই সেই ভালোবাসা, কবিরা যাকে বলেন ‘ব্যথার মতো সুখ’। ১৫ বছরের বেশিকাল পদটা আমায় ধরে রেখেছিল। আমি ধরে রাখিনি, ‘উপরে’ যাওয়ার ডাক না পাওয়ায় দীর্ঘকাল একই চেয়ারে বসে থাকা আর কী। যে বয়সে বার্তা সম্পাদককে দূর আকাশের তারা মনে হতো, তখন শুনতাম নিউজ এডিটর (বার্তা সম্পাদক) এমন একটা পদ যাকে বলা যায় ‘পত্রিকার প্রধানমন্ত্রী’। বিস্তর তাঁর জ্ঞান; প্রচুর তাঁর ক্ষমতা। অধস্তনরা তাঁর কপালের বিরক্তিকুঞ্চন স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কর্মস্থলে ‘টিকিয়া’ থাকেন।

আমার প্রথম ‘প্রধানমন্ত্রী’ আবদুল আওয়াল খান কিশোরগঞ্জের সন্তান। স্বল্পবাক, কর্মনিষ্ঠ ও অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। অন্যায় একচুলও বরদাশত করতেন না। আমার কপালগুণে তিনি কর্মগুরু; শিক্ষানবিশির শুরু তাঁর কাছেই। যখন ডাকেন বক্ষকম্পন চেপে রেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তাঁর কামরার তিন দিক পুরু কাচের বেড় দেওয়া। ঢুকবার আগে প্রস্তুতি নিই, কী প্রশ্ন করলে কী উত্তর দেব। কিন্তু দরজা পেরিয়ে কামরায় পা ফেলতেই সব ফন্দি বরবাদ। একবার তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে পাঁচ দিন গরহাজির আমি। শুনতে পাই, এতটাই কুপিত হয়েছেন যে, আমাকে শূলে চড়ানোর আশঙ্কা। কৈফিয়ত দিলাম ‘বাড়ি গিয়ে দেখি মা গুরুতর অসুস্থ। তাই দুদিন বেশি থাকতে হয়েছে। আর এরকম হবে না।’

‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ বললেন, আওয়াল ভাই, ‘ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে মাকে ফেলে রেখে চলে আসবে? গাধার গাধা! আমি কি ওটাই চাইছি? ইমার্জেন্সি ফেস করলে সেটা অফিসকে জানাবে। অফিসের সম্মতি নিয়ে অ্যাবসেন্ট থাকতে হবে দ্যাটস দ্য রুল।’ যথাসময়ে লাগসই বিষয়ে, নির্ভুল ও দ্রুতগতিতে সংবাদ রচনা ও পরিমার্জনার ওপর জোর দিতেন আওয়াল খান। বলতেন, ‘ডুয়িং থিংস টাইমলি, অ্যাপ্রুপ্রিয়েটলি, অ্যাকুরেটলি উইথ স্পিড ইজ দ্য সাইন অব আ ডিনামিক জার্নালিস্ট।’

কালক্রমে ১৯৯১’র জুনে বার্তা সম্পাদক হয়ে গুরুর রীতি-আদর্শ সমুন্নত রেখে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছি। এ জন্য পেশা ক্ষেত্রে দর ও আদর দুটোই যে কিছুটা পেয়েছি স্বীকার না করলে বিধাতা নারাজ হবেন। বার্তা সম্পাদক নিযুক্তির সংবাদে আমাকে প্রথম অভিনন্দন জানান জাহিদুজ্জামান ফারুক। ফোনে বলেন, ‘কী গুরু, দিলেন তো ফাটাইয়া। কাল আসেন মতিঝিল। দোস্তরা সবাই মিল্লা ভুনা খিচুড়ি পার্টি হবে। হোস্ট ফারুক রেডি ফর এভার।’ ফারুকের পর অভিনন্দিত করেন স্বনামখ্যাত হাসান শাহরিয়ার। ‘বেবী বলেছে ওর জন্য মিষ্টি নিয়ে আসতে। বাসার সবার জন্য মিষ্টি আনতে হবে।’

চিরকুমার শাহরিয়ার ভাই বাস করতেন মালিবাগে তাঁর ছোট বোন বেবীর বাসায়। বেবী আপা তাঁর বড় ভাইয়ের প্রিয়জনদের খুব সমাদর করতেন। লিখতে খুব কষ্ট পাচ্ছি যে, ভাইয়ের আগে চমৎকার এই ছোট বোনের মৃত্যু হয়েছে। হাসান শাহরিয়ার মারা যান ২০২১ সালের ১০ এপ্রিল। ক্যান্সারে ভুগে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাহিদুজ্জামান ফারুক।

ভোজ আয়োজনের ছুতো খুঁজতেন আমার বড় ভাই আবুল খায়ের। যে কোনো সুখবর উদযাপন করতে ন্যূনপক্ষে এক ডজন ব্যক্তিকে তিনি মধ্যাহ্ন বা নৈশভোজে ডাকতেন। একবার তো আমাদের বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসিতে চারটি লেটার পাওয়া এক শিক্ষার্থীর সম্মানে ছাগল খাসি জবাই করে ভোজ দিয়েছিলেন। ছোট ভাইয়ের কৃতিত্ব সংবাদ ছোট ভাইর মুখে না শোনায় খুব রেগে যান তিনি। সংকল্প করেন ‘শুয়রটার লগে সব কানেকশন কাট।’ সকালে গোসা, বিকালে আমার বাল্যবন্ধু অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেনকে ফোন, ‘হুইনছত্তি দেলু, তারু নিউজ এডিটর অইছে। কারে কারে দাওয়াত করন যায় তুই লিস্ট বানা।’ ‘তারু’ আমার ঘরোয়া নাম। দেলু বলে, ‘হিজারে (ওরে) জুতামো। এত বড় ঘটনা! আমারে একটু জানায় না। হিজা কোনো মানুষনি?’

রুষ্ট দেলোয়ার আমায় মানুষ বলে গণ্য করতে চাইছে না। বুঝলাম নিউজ এডিটর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমানুষ হয়ে গেছি? আমার কালের সব বার্তা সম্পাদককেই এক ধরনের অমানুষ হতে হয়েছিল। অমানুষ মানে অস্বাভাবিক মানবিক ও সামাজিক জীবন। যথাযথভাবে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা যেত না; যথাযথভাবে নিমন্ত্রণ করাও সম্ভব হতো না। এর ভুল ব্যাখ্যায় বলা হতো, ‘লোকটা নাকউঁচু’। বার্তা সম্পাদককে দুই বেলা অফিস করতে হতো। বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত। আবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৩টা, সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। কোনো কোনো রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে শুনতাম মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দেওয়া হচ্ছে।

বার্তা সম্পাদকের স্ত্রী-ভাগ্য মোটামুটি ভালোই। নইলে সংসার, সন্তান, জীবনবন্ধন সব তছনছ হয়ে যেত। কারও কারও হয়ে গেছেও। একজন নারী দিনভর ঘরদোর সামলেছেন, সন্তানকে খাইয়ে পরিয়ে শিক্ষালয়ে আনা-নেওয়া করেছেন, সকাল-সন্ধ্যা পড়া ধরছেন ছেলেমেয়ের। তারপর ক্লান্তদেহে বিছানায় গেছেন। ঘুমটা পাকা হতে চলেছে এমন সময় দরজায় বাজে ঘণ্টি। তখন ভোর হয় হয় অবস্থা। তিনি ঘুম থেকে জেগে স্বামীবরণে ছুটে যান। খাবার গরম করে পরিবেশন করেন। রোজকার এই দৃশ্যের মধ্যে কোনো একদিন খাওয়ার পর কর্তা হয়তো বলেন, ‘একটু চা কর খাই’। তখন কর্তার শিরোদেশে প্রস্তরাঘাত না করাটা ওই নারীর অপরিসীম ঔদার্যের পরিচয়ই বহন করে। এ ধরনের পরিচয়দাতাদের অন্যতম নিলুফার সুলতানা ডালিয়া ২০১০ সালের ২৫ নভেম্বর চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছেন। সম্পর্কে ইনি আমার স্ত্রী।

সাংবাদিক সমাজে আমোদ-বেদনার সঙ্গে একটা কথা মাঝেমধ্যে উচ্চারিত হয়-‘পত্রিকা বাজারে খুব চালু হলে কেউ যদি বলে, নিউজ এডিটর দারুণ। অমনি মালিকরা বলেন, ‘উনি কেডা? আমরা বিনিয়োগ করছি। বিনিয়োগ কথা বলছে।’ বাজার পাওয়ার গতি মন্থর হলে তারা বলেন, ‘হাঁদার হাঁদা নিউজ এডিটর ডোবাবে মনে হচ্ছে। ওরে কিক মেরে বে অব বেঙ্গলে ফেলা দরকার।’ আমার প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য কেউ অবশ্য করেননি। তবে মাসব্যাপী ছুটিতে থাকার সময় সম্পাদক যখন রিভিউ মিটিংয়ে সিনিয়র রিপোর্টারদের বললেন, ‘স্পেশাল রিপোর্টের অভাবে সার্কুলেশন কমে যাচ্ছে, আপনারা স্পেশাল দিচ্ছেন না কেন?’

তখন তারা বন্দুকের নলটা আমার দিকেই ঘুরিয়ে দিলেন। তারা স্পেশাল দেন না, কারণ তারা কর্মবিমুখ অলস ও উদ্ভাবন শক্তিরহিত জীব। সারা দুনিয়াতেই এই প্রকৃতির লোকদের মধ্যে লৌহদৃঢ় ঐক্য। তারা অবলীলায় বললেন, ‘স্পেশাল রিপোর্ট দিলে নিউজ এডিটর অবহেলা করেন। আজ রিপোর্ট করলে তা তিন দিন পরে ছাপেন। সার্কুলেশন তো কমবেই।’ সম্পাদক-মালিক বলেন, ‘তা-ই তো’!

ছুটি ভোগের পর অফিসে বসা শুরুর আগে বরাবরই আমি সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ঐতিহ্য রক্ষা করি। তিনিও সহাস্যে ‘আসুন আসুন’ করেন আর ছুটিটা কেমন উপভোগ করলাম জানতে চান। কিন্তু এবার দেখলাম তিনি ফাটোফাটো গম্ভীর। বললেন, ‘পত্রিকাটা কি রসাতলে নেওয়ার প্ল্যান করেছেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে অভিযোগ তুলে ধরলেন। বললাম, ‘আজকের রিপোর্ট তিন দিন পরে ছাপি, এটা কে বলেছে?’ তিনি তাঁর গ্লাসটপ টেবিলে প্রচ- থাবা মেরে গর্জে উঠলেন, ‘আপনার এত বড় স্পর্ধা! এডিটরের কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছেন।’ বুঝলাম, বড়িটা ওরা ভালোই গিলিয়েছে। এখন আমারও গেলাতে হবে। বললাম, ‘ঠিক আছে নাম বলতে হবে না। যারা তথ্যটা দিয়েছে তাদের আমার অপরাধটা প্রমাণ করতে বলুন। তাদের কাছে ২১ দিনের হিসাব চান।’ সম্পাদক বলেন, ‘মানে’? বলেছি, ‘ওদের অভিযোগ সত্য হলে তিন দিনে জমা-হওয়া রিপোর্ট নিশ্চয়ই আমি ২১ দিনে ছেপেছি।’

এতক্ষণে সম্পাদকের মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। এতক্ষণ আমি দাঁড়ানো। এতক্ষণ তিনি আমায় বসতে বলেননি। এখন বললেন, ‘বি সিটেড প্লিজ।’ বসলে তিনি বললেন, ‘ইয়োর প্রপোজিশন ইজ এক্সিলেন্ট ওয়ান।’ আমি বলি, ‘প্রমাণ করতে পারলে ইস্তফা দিয়ে চলে যাব।’ সম্পাদক বলেন, ‘নাইস’। বললাম, ‘আরও নাইস আছে। প্রমাণ করলে রিজাইন তো করবই, গেল সাড়ে পাঁচ বছরে যত টাকা বেতনভাতা নিয়েছি সব ফেরত দিয়ে যাব।’ সম্পাদক বলেন, ‘ভেরি নাইস’। বলেছি, ‘ভেরি নাইস আরও আছে। প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে ওদেরও ইস্তফা দিতে হবে। চাকরিকালে যত বেতনভাতা নিয়েছে সব ফেরত দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ও মাই গড! হাউ ক্র্যাফটি ইউ আর। শিওর! শিওর! নো সিনার শ্যাল রিমেইন আনপানিশড।’

প্রমাণ দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। সাত দিনের মধ্যে প্রমাণ চাই। জ্বলন্ত ইটভাটার ওপর চড়িয়ে দেওয়া বিড়ালের দশায় পড়ল চার সদস্যের সেই কর্মবিমুখ চক্র। কেননা কর্তৃপক্ষ বলেছিল, নিউজ এডিটরের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার সইব না, সইব না। ভিতরের ব্যাপার ছিল-এই চারজনের বেতনের অর্ধেক বেতনে কর্মঠ চারজনকে সংগ্রহের প্রক্রিয়া। আমার সুহৃদ এক সাংবাদিকের শরণ নিল ওরা। সুহৃদকে দর্শকের ভূমিকায় থাকতে বলি। তিনি শোনেন না। শেষতক তার চাপেই ওদের অনুকূলে বরফ গলেছিল।

অতীত নাড়াচাড়া করার সময় বিস্তর ছবি চোখে ভাসে। তার মধ্যে তিনটি নিবেদন করা যায়।

১. সাজেদ ও মাজেদ (প্রকৃত নাম নয়) দুই বন্ধু। তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করা। নবিশ রিপোর্টার পদে কাজ করছে স্মার্টলি। ছয় মাসের মাথায় কনফার্ম করার প্রক্রিয়ায় ওদের শিক্ষা সার্টিফিকেট তলব করা হয়। সাজেদ আমাকে জানায়, ‘ভাইয়া। বন্যায় আমাদের বাড়ির সব ভেসে গেছে। যে ট্রাঙ্কে সার্টিফিকেট ছিল সেটাও গেছে ভেসে।’ মাজেদ জানায়, ‘ভয়ংকর আগুন লেগেছিল বাড়িতে। সব পুড়ে ছাই। সার্টিফিকেটও।’

সাজেদ-মাজেদের মতোই স্মার্ট প্রশাসন বিভাগের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ কবিরুল ইসলাম। বলে, ‘নো প্রবলেম স্যার। তিনারা সত্যিই মাস্টার্স ডিগ্রিধারী কিনা তা জেনে নিচ্ছি।’ দুই দিন পরই কবির জানায়, তিনারা যে বছর পাস করেছেন বলে জীবনবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, ওই বছর সাজেদ ও মাজেদ, পিতা অমুক ও অমুক, এরকম কেউ পরীক্ষাই দেয়নি।

সাজেদ-মাজেদকে ডেকে বলি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে ‘ন্যূনতম যোগ্যতা ব্যাচেলর ডিগ্রি। তোমরা উচ্চশিক্ষিত সাজতে গেলে কেন?’ ওরা নিরুত্তর, অধোবদন। পরদিন তারা নিরুদ্দেশ। ওদের লজ্জাবোধ আমায় মুগ্ধ করে রেখেছে।

 

২. সফরুল নোমানী, সম্পাদনা সহকারী। সিনিয়র। সাত দিনের ছুটি দরকার তাঁর। আবেদনপত্রে লিখেছেন, ‘জরুরি পারিবারিক কারণে ছুটি চাই।’ তাঁকে বললাম, কারণ তো খুলে বলা উচিত। তিনি জানান, তাঁর শালি সন্তান প্রসব করবেন। প্রশ্ন করি, শালি কি বিধবা? নোমানী রুষ্টকণ্ঠে বলেন, ‘বিধবা হবে কেন’? বলি, স্বামী নিজেও তো তাঁর দফতর থেকে তিন দিনের বেশি ছুটি পাবেন না। দুলাভাইকে সাত দিন ছুটি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নোমানী বলেন, ‘ছুটি দেবেন না, সরাসরি বললেই চলে। ইনসাল্ট করেন কেন?’ বলেছি, ইনসাল্ট নয়, ইনফর্ম করেছি মাত্র।

পত্রিকার যারা মালিক তাদের একজনের স্ত্রীর বড়ভাই নোমানী। তিনি ভগ্নিপতিকে পরামর্শ দিলেন, ‘এই অভদ্র লোকটাকে অবিলম্বে তাড়াও।’ ধনাঢ্য ভগ্নিপতি বলেন, ‘আপনার পছন্দমতো কাজ না করলে সেটা অসভ্যতা হয়ে যায় না। তাছাড়া, মালিকের আত্মীয়কে অযথা প্রশ্রয় না দেওয়ার দায়ে চাকরিচ্যুতির প্রস্তাব পাস করা কঠিন হবে। আমি তো একা মালিক নই; আরও মালিক আছে।’

নোমানীর ভগ্নিপতিকে মনে মনে ‘শাবাশ’ বলেছি। নোমানীকে দিয়েছি থেরাপি। একদিন হুট করে তিনি আমার অফিস কামরায় ঢুকে পড়েন। কাজের প্রয়োজনেই। কিন্তু থেরাপিও তো দিতে হবে। বললাম, ‘হোসেন সাহেবের সম্বন্ধী, আপনাকে ঢুকবার অনুমতি দিইনি। যান বাইরে যান। অনুমতি নিয়ে ঢুকুন।’ মুখ কালো হয়ে যায় তার। নির্দেশ মতো কাজ করলেন।

আরেকবার সম্পাদকীয় পাতার জন্য হাতে লেখা একটা কপি বুঝতে পারছিলেন না। নোমানী চটজলটি কামরায় ঢুকে চেয়ারে বসে পড়লেন। কামরায় দুজন দর্শনার্থী ছিলেন। তাঁদের সামনেই থেরাপি দিলাম, ‘নোমানী বসলেন যে! আপনাকে কি বসতে বলেছি?’ থতমত খেয়ে তিনি বলেন, ‘স্যরি ভাইজান, স্যরি’। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বললাম, ‘ঘটনাটা আবার হোসেন সাহেবকে বলবেন না যেন। বললে আমার চাকরি যাবে।’

কাজ শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দর্শনার্থীরা চলে যাওয়া পর্যন্ত নোমানী দাঁড়িয়ে রইলেন।  বললেন, ‘ভাইজান, আর গোবরের গর্তে ডুবাইয়েন না। আল্লার ওয়াস্তে মাফ কইরা দেন।’

৩. আজিবর হাসান খান সিনিয়র সাব এডিটর। দুপুরের শিফটে কাজ করেন। টেলিপ্রিন্টারে সংবাদ এলে বাছাই করে অনুবাদ করান। তিনি অঘোষিত শিফট-ইন-চার্জ। মেধাবী ছাত্র ছিলেন; ইংরেজি আর বাংলায় সমান পারঙ্গম। কিছুদিন আগে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় শরিক হওয়ার পর থেকে দৃশ্যত তিনি পরলোকের অনুরাগী হয়ে পড়েন। তা পড়ুন হাজারবার, আপত্তি করবার আমরা কে! আমরা দেখলাম পরলোক বিষয়ে গভীর মনোযোগী আজিবর খান ইহলোকের চাকরিটাও আঁকড়ে আছেন।  অথচ চাকরির প্রতি সুবিচার করছেন না। নালিশ পাই, জামাতে নামাজ আদায় করলে সীমাহীন সওয়াব। তাই শিফটের জুনিয়রদের কিছু না জানিয়ে তিনি জোহর ও আসরের ওয়াক্তে ছুটে যান মসজিদে। এই বাবদে তিনি প্রতি ওয়াক্তে এক ঘণ্টা অফিসের বাইরে থাকেন।

এক দুপুরে দেখি নিউজরুম খাঁ খাঁ করছে। তুলসী দাস নামে এক পিয়ন জানায়, ‘খান স্যার এসেছিলেন, মসজিদে গেছেন নামাজ পড়তে। জুনিয়র সাব-এডিটররা এখনো কেউ আসেননি। আধা ঘণ্টার মধ্যে তারা হাজির। খান সাহেবের দেখা নেই। পৌনে ৩টার দিকে তিনি এলেন। বললাম, ‘অফিস অরক্ষিত রেখে কখনো মসজিদে যাবেন না।’ আজিবর খান যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘বলেন কী! নামাজের জন্য মসজিদে যাব না?’

‘অবশ্যই যাবেন। তবে অফিসটা নিরাপদ অবস্থায় রেখে যাবেন’ বলেছি আমি, ‘প্রয়োজনে অফিসেই তো নামাজ পড়া যায়।’ খান বলেন, ‘অফিস কী এতই পলকা যে কেউ তা পকেটে পুরে নিয়ে যাবে!’ বললাম, ‘অফিসে লাখ টাকা দামের যে টেলিপ্রিন্টার সেটা চুরি করা কি খুব কঠিন? নামাজ আদায় না করলে গুর্জাঘাত করা হবে পরকালে। টেলিপ্রিন্টার খোয়া গেলে গুর্জাঘাতটা পেয়ে যাব নগদানগদ ইহকালেই। ক্লিয়ার নাউ?’

আজিবর বলেন, ‘ক্লিয়ার না হওয়ার কী আছে।’ তাঁর উচ্চারণের ভঙ্গি আর চেহারা বলছিল, কথাগুলো তাঁর মনের কথা ছিল না। তার সঙ্গে আমার সংলাপের বিবরণ দিয়ে তিনি সহকারী নিউজ এডিটর মাশুক চৌধুরীকে (কবি মাশুক চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায় মৃত্যু : ২৩ জুন ২০২০) বলেছেন, ‘এরকম একটা জঘন্য কমিউনিস্টকে আল্লাহ ফেভার করতে করতে কোথায় উঠাইলো দেখছেন?’

‘তা-ই!’ বলেছেন মাশুক চৌধুরী, ‘আল্লাহ তাইলে কমিউনিস্টগোরেও ফেভার করে। জেনারেল নলেজটা বাড়াইয়া দিছেন। থ্যাংকস আ লট।’

জগৎ বাস্তবতা : ট্রেন, স্টিমার, বাস এমনকি উড়োজাহাজেও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা আমার বহুদিনের অভ্যাস। বিচিত্র চরিত্রের দেখা পাই এসব ভ্রমণে। এ সময় আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে চায় উরুগুয়ের সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক এদুয়ার্দো গায়লিমুর (জন্ম : ৩.৯.১৯৪০-মৃত্যু : ১৩.৪.২০১৫) একটা কথা। তিনি বলতেন, জগতের বাস্তবতাগুলোর দিকে আমি যে সজাগ রয়েছি, এ জন্য আমি সাংবাদিকতার কাছে কৃতজ্ঞ (আই অ্যাম গ্রেটফুল টু জার্নালিজম ফর ওয়েকিং মি আপ টু দ্য রিয়েলিটিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড)।

এ ধরনের ভ্রমণযাত্রার সঙ্গী শিক্ষিতজনরা যে আন্তরিকতা দেখান তা দেখেছি, কপটতাপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এঁরা তাদের যে কোনো একটা প্রকল্প সার্থক করবার মানসে ‘ভালো থাক মোর প্রাণসখা হে’ ভঙ্গি করেন। ভ্রমণ শেষে, বছর দুয়েক পরেও এরা ফোনে কিংবা সাক্ষাতে তাঁদের অনুকূলে মতলবি সংবাদ পরিবেশনের আবদার করেন এবং আবদারের মাঠ তৈরির প্রস্তুতিস্বরূপ নামি-দামি হোটেলে তাঁর সঙ্গে চারটে ডালভাত খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। উপদ্রব আরও আছে- ‘আমার ভাতিজার লেখা একটা ছোট গল্প আপনাদের ঈদ সংখ্যায় ছাপিয়ে দিন না।’ বউ লেখক, শ্বশুর লেখক, ‘কলেজে এই স্যারের কাছে পড়েছি’ কিসিমের শিক্ষক এমনকি শ্বশুরালয়ের ঘনিষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যানের রচিত পদ্য বা নিবন্ধ ছাপানোর জন্য তাগিদ পাই। এখন যে প্রায় ১৭ বছর ধরে ‘প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক’গিরি করছি, তবুও অনুরোধযন্ত্রণা থেকে রেহাই নেই।

সীমাবদ্ধতাটা খোলাসা করলে অনেকেই রূঢ় বাস্তবতা মেনে নেন। কেউ কেউ আছেন, নিজের স্বপ্নটা ছাড়া আর কিছু বুঝতে চান না। এ রকম একজন মনির পাটোয়ারি। ইনি মধ্যস্তরের ব্যবসাদার। কিন্তু খরচ করেন ইলন মাস্কের স্টাইলে। আক্ষরিক অর্থেই জনদরদী। নিজ উপজেলার উন্নয়ন প্রয়াসে বিনিদ্র এক যোদ্ধা তিনি। এক সন্ধ্যায় মতিঝিলের মেরেলিন রেস্তরাঁ থেকে গ্রিলড চিকেনের প্যাকেটসমেত এলেন জনকল্যাণব্রতী মনির পাটোয়ারি। ব্রিফকেস থেকে বের করলেন হাতে লেখা কিছু কাগজ আর সাদাকালো ছবি। বললেন, ‘আগে গ্রিল খান। প্রজেক্ট শুনলে টাসকি লেগে যেতে পারে।’

দীর্ঘ কাহিনি লিখে এনেছেন। একটা গোরস্তান কর্তৃপক্ষীয় অবহেলায় কীভাবে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে সেই কাহিনি। প্রস্তাব করেন, তিনটি ছবিসহ পুরো কাহিনি ছাপতে হবে। কেননা অতিসজ্জন জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, পত্রিকায় বিশদভাবে বিষয়টি এলে দ্রুত অ্যাকশন নিতে তাঁর সুবিধা হবে। বললাম, ‘মূল সমস্যাটির বিষয় সংক্ষেপে ছাপিয়ে দেন। আশা করি কাজ হয়ে যাবে।’

মনির পাটোয়ারির পীড়াপীড়ি চলতেই থাকে। সংক্ষেপ নয়, বিশদ ছাপতে হবে। আমিও সমানে ‘না-না’ করি।  তিনি একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম? হোয়াই ইউ রিফিউজ স্টাবোর্নলি?’ বললাম, ‘ল্যাকিং পাওয়ার টু প্রিন্ট দ্য হোল জাম্বো।’

বিস্মিত পাটোয়ারির প্রশ্ন, ‘সত্যিই আপনি পাওয়ারলেস?’ জবাব দিই, ‘জি, হ্যাঁ’।

কাগজ আর ছবিগুলো টেবিল থেকে গুটিয়ে নিয়ে ব্রিফকেসে ঢোকালেন তিনি।  এরপর একটা সাদা কাগজ আমার সামনে দিয়ে বলেন, ‘পাওয়ারলেস একটা লোক গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে বসে পা দোলাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। নিন, জলদি রিজাইন করুন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর