বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) বিভিন্ন শাখায় আউট সোর্সিং খাতে অর্থাৎ মাস্টার রোলে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাগজে-কলমে কাজ করেন প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী। প্রতিমাসে তাদের পেছনে করপোরেশনের ব্যয় এক কোটি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। যথা সময় বেতন না দিতে পাড়লেই শুরু হয় আন্দোলন। এতে করপোরেশনের কাজে যেমন স্থবিরতার সৃষ্টি হয়, তেমনি সেবা বঞ্চিত হয় নগরবাসী। কিন্তু যাদের পেছনে প্রতিমাসে কোটি টাকা ব্যয় হয়, যাদের কারণে নাগরিক সেবা বাঁধাগ্রস্থ হয় সেই মাস্টার রোল কর্মচারীদের নিয়োগ কবে কিভাবে হয়েছে তার কোন হদিস নেই কারোর কাছে। সিটি করপোরেশনের ব্যয় সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পর্যবেক্ষনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করপোশেনের সবগুলো বিভাগের মাস্টার রোল কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া তলব করেছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
বিসিসি কর্মচারীরা বলেছেন, দেড় হাজার কর্মচারীর বেশীরভাগ জানেন না তারা কোন শাখায় কাজ করেন, কি তাদের দায়িত্ব। তারা জিন্স প্যান্ট এবং ভালমানের শার্ট পড়ে ঘুড়ে বেড়ায়, নিজেদের ব্যবসা-ধান্ধা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, মাস শেষে শুধু সিটি করপোরেশন থেকে বেতন নিয়ে যান। করপোরেশনের সবাই এটাকে ‘আলিস্যা (অলস) ভাতা’ বলে থাকেন।
বিসিসি’র প্রশাসনিক শাখা সূত্র জানায়, বিগত সময়ে আউট সোর্সিং খাতে প্রায় ১২শ’ কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিলো। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর এই খাতে প্রায় আড়াই শ’ কর্মচারী নিয়োগ করেন। এদের মধ্যেই কাজ না করার প্রবনতা বেশী। সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউপি সদস্য বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির কামালও দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে বিসিসি’তে কাজ করছেন। তিনি নিয়োগ পেয়েছেন বর্তমান মেয়রের শুরুর দিকে। জনপ্রতিনিধি হয়েও মাস্টার রোলে চাকুরী করার বিষয়ে জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিসি’র এক স্থায়ী কর্মচারী জানান, স্টোর অফিসার মো. আলমগীর হোসেন একাই তার ফুট-ফরমায়েশ করানোর জন্য ৫জন কর্মচারী খাটান। সেটেলমেন্টের কর্মচারী তার স্ত্রীর দুপুরের খাবার অফিসে পৌঁছে দেয়া, বাসার বাজার-সদায়-দুধ পাঠানো সহ ব্যক্তিগত কাজেই ব্যস্ত রাখেন ৫ কর্মচারীকে। তার মতো অনেকেই মাস্টার রোল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত রাখেন।
একজন প্রভাবশালী কাউন্সিলরের ভাতিজা আবিদ হাসান সাব্বিরকে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর কর আদায় শাখায় কাজে দেয়া হয়। দৈনিক ৩শ’ টাকা মজুরী ভিত্তিতে ২-৩ মাস কাজ করার পর এখন আর তিনি অফিসে আসেন না। শাখা প্রধান বিল করেন, তিনি এবং তার মতো ঘুড়ে বেড়ানোরা মাস শেষে বেতন নিয়ে যান। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যুত শাখায় তানজিলা নামে একটি মেয়েকে কাজে দিয়েছেন। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরী ভিত্তিক কর্মচারী ওই মেয়েটিও কাজে আসে না। মাস শেষে বেতন নিয়ে যান। তার মতো পানি শাখার আব্দুস ছাত্তারও কাজ না বেতন পান। তড়িঘরি কাজ করে দেয়ার কথা বলে বখশিস নেয়ার অভিযোগে জন্ম নিবন্ধন শাখার কার্য সহায়ক মো. রিয়াজকে কিছুদিন আগে শাস্তিমূলক বদলী করা হয় প্রধান প্রকৌশলীর নগরীর ফজলুল হক এভিনিউ’র ব্যক্তিগত কনসালটেন্সি অফিসে- সংশ্লিস্ট সূত্র এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
২০০৯ সালে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের আমলে মাস্টার রোলে চাকুরী পেয়েছেন টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারন সম্পাদক হুমাউন কবির। তিনি বলেন, মেয়র হিরন তাকে মাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে মাস্টার রোলে কাজ দিয়েছেন। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর বেতন সাড়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়। আবার বেতন বাড়িয়ে ৭ হাজার করা হয়। পরে আবার বেতন কমিয়ে সাড়ে ৪ হাজার করা হয়। তিনি বলেন, যুবলীগের পদে থাকলেও কমিটি ৯ বছরের পুরনো। দলের কাজ এবং সিটি করপোরেশনের ল্যান্ড সার্ভে শাখায় যথাযথভাবেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বিসিসি’র পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধা বলেন, তার শাখায় প্রায় ৫শ’ মাস্টার রোল কর্মচারী আছে। তাদের নিয়োগ যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। তারা সবাই কাজে আসেন। তিনি বলেন, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর প্রশাসনিক শাখার মাধ্যমে ৫০ থেকে ৬০জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের কাগজপত্রে ঘাটতি থাকতে পারে।
বিসিসি’র নির্ভরযোগ্য সূত্র নাম না প্রকাশের শর্তে জানায়, আউট সোর্সিং কর্মচারীদের অনেকে কাজ চায় কিন্তু সংশ্লিস্ট শাখা প্রধানরা তাদের নির্দিষ্ট কাজ দেন না, আবার অনেকে হাড়ভাঙ্গা কাজ করেন। আবার কাজ করেন না ঘুড়ে বেড়ান, মাস শেষে বেতন নিয়ে যান এমনও আছেন অনেক। কেউ কেউ বলেন মোট কর্মচারীর মধ্যে অন্তত ৫০ ভাগ নির্দিষ্ট কাজ করেন না। তবে ওই সূত্রটির দাবী এই হার কমপক্ষে ৩০ ভাগ।
বিসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, কাজ না করেও অনেকে মাস শেষে বেতন নেন, এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। করপোরেশনের ব্যয় সংকোচনের জন্য সবগুলো বিভাগীয় প্রধানদের কাছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আউট সোর্সিং কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া যাচাই করা হচ্ছে। এর পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে মেয়র আহসান হাবিব কামালের ব্যক্তিগত দুটি মুঠোফোন নম্বরে কল দেয়া হলেও দুটি ফোনই বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার