প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন গ্রেফতার হওয়া হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। আদালতকে তার দেয়া এক জবানবন্দি থেকে এমনটা ধারণা করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল বজলুর রশীদের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টি গঠিত হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র হামলা করে। নিরাপত্তারক্ষী হাবিলদার জহিরুল হক ও কনস্টেবল জাকির হোসেন জীবনবাজি রেখে সেই হামলা প্রতিহত করেছিলেন। সেদিনের সেই টার্গেট কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন ফ্রিডম পার্টির মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি থানার সমন্বয়ক মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা। এ মোস্তফারই বড় ভাই মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। তিনি প্রায় ২০ বছর আগে আদালতকে জানিয়েছিলেন, আমার ভাই মোস্তফার সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। মোস্তফা কি কাজ করতো কোথায় যেতো এসব বিষয়ে আমার মোটামুটি ধারণা ছিল।
১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে গ্রেনেড বোমা হামলার পাশাপাশি বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। এ সশস্ত্র হামলার নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন দু’তলার কক্ষে অবস্থান করায় প্রাণে রক্ষা পান। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ধানমন্ডি থানায় মামলা নম্বর-২৪, তারিখ- ১১/০৮/৮৯। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা হামলার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী দলের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ কোন্দলে মোস্তফা মারা যান। মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের আব্দুল মালেক মিয়ার ছেলে ফ্রিডম মোস্তফা হত্যা মামলায় আদালতে স্বাক্ষী দিতে গিয়ে হাবিবুর রহমান মিজান স্বীকার করেন তার ছোট ভাইয়ের কাণ্ডকীর্তি সম্পর্কে তিনি সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখতেন। মোস্তফা কী করতেন, কোথায় যেতেন সবকিছুই ছিল তার নখদর্পণে।
সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজানকে র্যাব গ্রেফতার করে। গতকাল শুক্রবার ভোরে তাকে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, ফ্রীডম পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, খুন ও সন্ত্রাসে জড়িত থাকার বহু অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে থাকা মিজান শ্রীমঙ্গল সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন- এমন খবরের ভিত্তিতে শ্রীমঙ্গলের গুহ রোডের মৃত ফজলুর রহমানের বাসা থেকে তাকে ধরা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, পাগলা মিজান ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি থেকে শুরু করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাসায় যারা হামলা করেছিল তার একজন পাগলা মিজান। অথচ সময়ের স্রোতে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। ভোল পাল্টিয়েছেন তিনি। পাল্টে ফেলেছেন নামটিও। তিনি এখন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেছেন অপরাধ সাম্রাজ্য। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধমূলক কাজে তার নাম উঠে এসেছে বার বার। আওয়ামী লীগের এই নেতার বর্তমান নাম হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান হলেও আগে তার নাম ছিল মিজানুর রহমান মিজান। সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার শুধু টেন্ডারবাজি করেছে। এ ছাড়া ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক তিনি। স্থানীয়রা বলেন, খুনখারাবি তো পাগলা মিজানের বাম হাতের খেলা। ভয়ে এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথাও বলে না। ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন এই পাগলা মিজান। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তা তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা