সময়টা ছিল ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। তৎকালীন এমপি ডা. ইকবালের সমাবেশ। সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আক্তার, ফারজানা ইয়াসমীন বিপ্লবীসহ আরও অনেকেই। ইকবালের বক্তব্যের পরপরই পুলিশের হামলা হয়। এতে যুব মহিলা লীগের কয়েক কর্মী আহত হন। এর মধ্যে একজনের বস্ত্রও ছিঁড়ে যায়। সেটি গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরা বন্দি হয়।
ওই ছবিটি ঘটনার পরের দিন ১৩ সেপ্টেম্বর দেশের সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রধান খবর হয়। তোলপাড় শুরু হয় শ্লীলতাহানীর ঘটনায়। যার বস্ত্র ছিঁড়েছিল তিনি ছিলেন ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুব মহিলা লীগের কর্মী আয়েশা আক্তার। এমনকি, তৎকালীন সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরার যে পোস্টার হয়েছিল, সেখানেও স্থান পেয়েছিল যুব মহিলা লীগের কর্মী আয়শা আক্তারের ওই ছবিটি।
সেসময় আলোচিত মুখ ছিলেন আয়শা। এরপর আওয়ামী লীগ টানা তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। হিসাব মতে আয়শার অবস্থান হওয়ার কথা ছিল বেশ ভালো একটি স্থানে। কিন্তু তা হয়নি। বরং রোগে শোকে ধুকে ধুকে চিকিৎসার অভাবে মরতে বসেছিলেন তিনি। স্বামী নেই, একটি সন্তান নিয়ে বৃদ্ধ বাবা মায়ের সংসারে এসে খেয়ে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন তিনি।
তবে রাজনৈতিক মাঠে নিজের সহযোদ্ধা, সহকর্মী আয়শার জন্য মন কেঁদে উঠে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারজানা ইয়াসমীন বিপ্লবীর। সংগঠনটির সভাপতি সাবেক এমপি নাজমা আক্তারের নির্দেশক্রমে আয়শার সন্ধান করতে থাকেন তিনি। এমনকি, তার সন্ধান চেয়ে তৎসময়কার পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিসহ বিপ্লবী তার ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেই সূত্র ধরেই সন্ধান পাওয়া যায় আয়শা আক্তারের।
৬ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন আয়শা আক্তার। কি হয়েছে, কোথায় আছে কেউ তার কোনো সন্ধান পাননি। অথচ আয়শা আক্তার পরে ছিলেন নারায়ণগঞ্জের চাঁনমারী এলাকায় তার বৃদ্ধ বাবা মায়ের কাছে। এক সন্তান তার। স্বামী নেই। তার স্বামী তাকে বহু আগেই ছেড়ে চলে গেছেন। রাজনীতির কারণেই নাকি তার স্বামী তাকে ছেড়েছিলেন। সেই থেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
রবিবার (১ মার্চ) বিকেলের দিকে সেই আয়শা আক্তারকে নারায়ণগঞ্জের চাঁনমারী এলাকা থেকে উদ্ধার করেন যুব মহিলা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। অথচ নারায়ণগঞ্জে রয়েছেন কত না বাঘা বাঘা নেতা। কেউ কোনোদিন খোঁজ নেননি আয়েশার। এ লজ্জা এখন নারায়ণগঞ্জের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ও কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারজানা ইয়াসমীন বিপ্লবী বলেন, আয়শা রাজপথের সৈনিক ছিলেন। তিনি আমাদের সাথেই রাজনীতি করতেন। তিনি ছিলেন ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুব মহিলা লীগের সদস্য।
তিনি আরও বলেন, দল ক্ষমতায় আসার পর আমাদের সভাপতি সাবেক এমপি নাজমা আক্তার বিভিন্ন ফান্ড থেকে এবং নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বিভিন্ন সময় আয়শাসহ আরও অনেককেই সহযোগিতা করে আসছিলেন। ভালোই ছিল। কিন্তু গত ৬ বছর ধরে আয়শা নিখোঁজ ছিল। নানাভাবেই তার সন্ধান করা হয়। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। শেষে নাজমা আক্তারের সাথে পরামর্শ করে এবং তার নির্দেশে আয়শার খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করি। এরপরই ফেসবুকে খবর আসে আমাদের যুবলীগের বিল্লাল আয়শাকে দেখতে গিয়েছিলেন। পরে অ্যালিফ্যান্ট রোডে গিয়ে বিল্লালের কাছ থেকে তার ঠিকানা সংগ্রহ করি। পরে সভাপতি নাজমা আক্তারের সাথে এ নিয়ে কথা বলা হয়।
বিপ্লবী আরও বলেন, নাজমা আক্তারের নির্দেশে আগে আয়শাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি এখন ঢামেকের ইউনিট-২ ওয়ার্ড-৮০২ এ ভর্তি রয়েছেন।
ডাক্তাররা জানিয়েছেন, আয়শার কিডনীর সমস্যা রয়েছে। আমরা আমাদের সাধ্যমত ওর চিকিৎসা চালিয়ে যাব। পরবর্তীতে সামলে উঠতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হব।
২০০৬ সালের সেই ১২ সেপ্টেম্বরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফারজানা ইয়াসমীন বিপ্লবী বলেন, সেদিন আমরা পুলিশের হামলায় আয়শাসহ সাতজন আহত হই। ওইদিন পুলিশ যখন আয়শার জামা ছিড়ে ফেলল তখন আমি আমার ওড়না খুলে ওর শরীর ঢেকে দেই। তবে সব পুলিশ খারাপ ছিল না। সেদিন একজন পুলিশ এসে একটি শার্ট দিয়ে আয়শার শরীর ঢেকে দিয়ে আমার ওড়নাটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে আয়শাসহ আমরা সাতজন হলি ফ্যামেলি হসপিটালে ভর্তি হই। সেসময় আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন ডা. ইকবাল হোসেন, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারা।
তিনি আরও বলেন, ডা. ইকবাল যোগাযোগ করলেন এবং তিনি নির্দেশ দিলেন শাহজাদপুরে প্যান প্যাসিফিক হসপিটালে ভর্তি হতে। সেখানে আমরা ভর্তি হই। আমাদের দেখতে আসছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি দেখতে আসার পরেই সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে আমরা সেখানে আছি। সেই সাথে জানতে পারি পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করার জন্য খুঁজছে। এর মধ্যে আয়শার ছবিটি সবাই দেখেছে। সেসময় ও পরিচিত মুখ। তাই হসপিটাল থেকে দ্রুত চলে আসি। পরে আমাদের সভাপতি নাজমা আক্তারের তত্ত্বাবধায়নে ও তার নির্দেশক্রমে আমরা অন্যত্র চিকিৎসা নেই।
বিপ্লবী আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতি যেহেতু করি মেয়েটি চাইলেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো। কল করতে পারতো। কারো কাছ থেকে নম্বরও নিতে পারতো। কিন্তু সে এর কিছুই করেনি। কিন্তু কেন করেনি তা বুঝতে পারছি না। আমাদের প্রতি ওর অধিকার রয়েছে। আমাদেরও কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা সবাই ছুটে গিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আয়শা আমাকে দেখেই চিনেছে। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কথা তেমন একটা বলতে পারে না। খুব আস্তে আস্তে সে আমার নাম ধরে ডেকেছে। সভাপতি নাজমা আক্তারের নামও ওর মনে আছে। ও আমাদের দলের কর্মী। নিবেদিত প্রাণ। আমরা ওর চিকিৎসা করাবো। এটা আমাদের দায়িত্ব। আশা করি ও নিশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবে। ওর একটা বাচ্চা আছে। অন্তত বাচ্চার জন্য হলেও ও সুস্থ হবে। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো। নিজেরা পেরে না উঠতে পারলে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো।
এদিকে, আয়শা আক্তারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে দেখতে সেখানে আসেন সাবেক এমপি ও যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আক্তারসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকর্মীরা। নিজেদের হারানো সহকর্মীর এমন করুণদশা দেখে উপস্থিত সকলেই কেঁদে ফেলেন।
বিডি প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ/এনায়েত করিম