সাভারের সোবাহানবাগের জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু এ সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দেশের প্রায় ৯ হাজার যুবক। এর মধ্যে কেউ কেউ শিল্পপতিও হয়ে উঠেছেন। যারা এক সময় বেকার ছিলেন তারা অনেকে এখন মাসে আয় করছেন লাখ টাকার ওপরে।
এই মাশরুম চাষেই মাগুরার ‘ড্রিম মাশরুম সেন্টার’, নীলফামারীর সৈয়দপুরের ‘ফাতেমা মাশরুম’সহ অনেক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এবং দেশের মানুষের পুষ্টি দূর করতে সরকার আশির দশকে জাপানের সহায়তায় দেশে মাশরুম চাষ শুরু করে।
এরপর সরকার নানাভাবে চেষ্টা করলেও ২০০০ সাল পর্যন্ত মাশরুম চাষের তেমন উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। তবে এরপর থেকেই ধীরে ধীরে দেশে বাড়তে থাকে মাশরুম চাষ। বিশেষ করে সাভারে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট হওয়ার পর থেকে সেখানে বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এসে বেকার যুবক ও যুবতীরা এখান থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। এভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
হাট ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজি তাজা ওয়েস্টার মাশরুমের মূল্য ২৫০ টাকা ও শুকনো বা গুঁড়া ওয়েস্টার মাশরুমের মূল্য ১৪০০ টাকা। এক কেজি তাজা বাটন মাশরুমের মূল্য ৫০০ টাকা। এক কেজি শুকনো বা গুঁড়া ঋষি মাশরুম ৪০০০ টাকা। এক কেজি তাজা কান মাশরুম ২০০ টাকায় এবং শুকনো কান মাশরুম ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গোলাপী বেগম নামের এক নারী তিন জাতের মাশরুমের পসরা নিয়ে বসেছেন হাটে। প্রায় তের বছর ধরে তিনি মাশরুম চাষ করছেন বলে জানান। মাশরুমের হাটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে অনেকটা ছোট পরিসরে চাষ শুরু করেছিলাম। তখন মধুর ক্যান্টিন, হিমুর ক্যান্টিন ও আবুলের ক্যান্টিনে মাশরুম বিক্রি করতাম। এখন বড় পরিসরে চাষ করছি। আমার কাছে বিভিন্ন জাতের এক হাজার মাশরুমের বীজ আছে। ঢাকার বিভিন্ন সুপার শপে আমি মাশরুম সরবরাহ করি। এখন প্রতিমাসে প্রায় বিশ হাজার টাকা আয় করি।
মাশরুমের হাট সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে ঢাকা থেকে অর্ডার না এলে মাশরুম বিক্রি করতে পারতাম না। বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় আমাদের একেক সময় একেক জায়গায় বসতে হতো। তবে এখন নির্দিষ্ট জায়গা পেয়ে আমাদের অনেক লাভ হচ্ছে। প্রতিদিনই ক্রেতার সংখ্যা বাড়েছে।
গোলাপী বেগমের মতো এখন অনেক অসহায় ও বেকার পুরুষ-মহিলা মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই ইনস্টিটিউট থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫ হাজার ৫৮১ জন মাশরুম চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব চাষি তাদের উৎপাদিত মাশরুমের একটি অংশ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছেন। অবিক্রিত যে মাশরুম বিক্রির জন্য তারা পাঠিয়ে দেন সাভারের এই হাটে। এছাড়া ২৮ জন চাষি প্রতিদিনই তাদের উৎপাদিত মাশরুম এই হাটে বিক্রি করেন।
মাশরুমের এ হাটটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক ড. নিরোদ চন্দ্র সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাশরুম চাষ আমাদের দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দিক। সরকার সঠিকভাবে মাশরুম চাষের দিকে নজর দিলে মাশরুম চাষ একটি অন্যতম সাফল্যমণ্ডিত ক্ষেত্রে পরিণত হবে। এখান থেকে হাজার হাজার বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মাশরুম চাষের দিকে নজর দিলে সম্ভাবনাময় মাশরুম চাষ আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের ছত্রাকবিদরা এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ প্রজাতির ছত্রাক শনাক্ত করেছেন। এসবের মধ্যে মাশরুম হলো মানুষের খাওয়ার উপযোগী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ। মাশরুম চাষ করা সহজ, সাশ্রয়ী ও পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি হালাল খাবার। বাসাবাড়িতে সহজেই এটি চাষ করা যায়। যারা মাশরুম চাষ করতে চান, আমরা তাদের সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি।
বারডেম-পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়েস্টার মাশুরুম লিভার ও কিডনিকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে। এ মাশরুম রক্তের সুগার, কোলেস্টরেল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে, যা ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।
ইনস্টিটিউটে ঢুকতেই ডান পাশে চোখে পড়বে মাশরুম ফুড কর্নার। এটি পরিচালনা করছেন সাভারের জামসিং এলাকার পারভীন আক্তার। তিনি বিধবা। তার একমাত্র সন্তান আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। প্রতিদিন এ খাবার দোকান থেকে পনেরশ থেকে দুই হাজার টাকা আয় করেন। এ আয় দিয়েই চলে তার সংসার। এই ফুড কর্নারে তিনি মাশরুম দিয়ে রোল, পাকোড়া, বার্গার, চপ, সমুচা তৈরি করেন। সকাল ১০টা থেকে রাত ৯ পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন বলে জানান তিনি।
মাশরুম একটি ঔষধি গুণসম্পন্ন আদর্শ খাবার। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মাশরুমে প্রায় ২৫ শতাংশ আমিষ রয়েছে। যাতে মানুষের শরীরের জন্য ৯টি অত্যন্ত জরুরি অ্যামাইনো এসিড রয়েছে।
মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ
সাভার মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এতদিন মাশরুম চাষে আগ্রহীদের প্রতিষ্ঠানে সরাসরি প্রশিক্ষণ দিলেও করোনাভাইরাস কারণে লকডাউন শুরুর পর তা বন্ধ রয়েছে। তবে আগ্রহী যুবক ও মাশরুম চাষিদের কথা চিন্তা করে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ গত আগস্ট মাস থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে।
এখানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন আগ্রহী যুবক অংশ নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। যে কেউ চাইলে অনলাইন প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম জুম সিটিং আইডি ৯৮৬৭৪৫১০৭৭ এবং পাসকোর্ড (কাকন ইংলিশে ) লিখে অংশ নেওয়া যায়।
বিডি প্রতিদিন/এমআই