লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ডায়াসে মাইক নেওয়া এবং নেতাদের সামনে স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে চরম হট্টগোল, হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এসময় মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
পরে স্লোগানধারী কর্মীদের উদ্দেশে গালিগালাজ করেন খোঁদ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। আর মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও কাউন্সিলর আনিসুর রহমান স্লোগানধারীদের হুমকি দেন ‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে কাউকে ঘরে ঘুমাতে দেওয়া হবে না। পুলিশ ঘরে ঘরে গিয়ে শায়েস্তা করবে।’
আজ বিকালে লালবাগের নবাবগঞ্জ পার্কে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া সম্মেলন চলাকালে পুরো সময়ই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। সম্মেলনের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় হাতাহাতি হয়েছে। মাইকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হলেও থামেনি বিশৃঙ্খলা। মহানগর নেতাকর্মীদের এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
জানা যায়, বিকেল তিনটায় রাজধানীর লালবাগের নবাবগঞ্জ পার্কে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমদ মন্নাফি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাংগঠনিক গোলাম আশরাফ তালুকদার প্রমুখ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল তিনটায় সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মহানগর আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা মঞ্চে আসতে দেরি করেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, আইন সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু, কেন্দ্রীয় সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের শুরুতে হাজী সেলিমের ছেলে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রার্থী সোলায়মান সেলিমের সমর্থকদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। পরে দু পক্ষের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হলে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দ্বিতীয় দফায় হাজী সেলিম সমর্থকদের সঙ্গে ২৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়। সম্মেলন শুরু হলে আবারও মারামারিতে জড়ান হাজী সেলিমের সমর্থক, মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের সমর্থক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে। এক পর্যায়ে পুলিশ সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সমর্থকরা পুলিশের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সম্মেলন মাঠের গেট লাগিয়ে দেয় পুলিশ। তখন গেট ভেঙে সম্মেলন কেন্দ্রে প্রবেশ করেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সমর্থকরা।
পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুরু হলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বক্তব্য দেয়ার মধ্যেই সম্মেলনের মাঠে আবারও মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন হাসিবুর রহমান মানিক ও হুমায়ুন কবির সমর্থকরা।
এ সময় আব্দুর রাজ্জাক মারামারি থামানোর জন্য নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘মারামারি থামানোর জন্য আহ্বান করছি। বিশৃঙ্খলা করবেন না, বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। থামুন আপনারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপনাদরর মাঝে এসেছে, এর গুরুত্ব উপলব্ধি করুন আপনারা। আবারও আহ্বান করছি থামুন।’ এক পর্যায়ে নগর আওয়ামী লীগ নেতারা মঞ্চ থেকে নেমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এর আগে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করা নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই কাউন্সিলর আনিসুর রহমান আনিস ও হাসিবুর রহমান মানিক প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই সম্মেলনস্থলে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকা দক্ষিণের ২৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক। এ সময় ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য আনিসুর রহমান আনিস ডায়াসে এসে হাসিবুর রহমান মানিককে ধমক দিয়ে সরে যেতে বলেন। তিনি মাইক ছেড়ে দিলে সভাস্থলে তার কর্মীরা চিৎকার চেচামেচি করে আনিস বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। মানিক সমর্থকরা আনিসকে স্টেজ থেকে বিতাড়িত করতে তেড়ে যান। পরে পুলিশ ও মহানগরের কয়েকজন নেতা বিষয়টি মিমাংসা করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মানিক সমর্থকরা তখনও স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আনিস বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মাইক ছেড়ে স্টেজের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান কাউন্সিলর আনিসুর রহমান আনিস। পরে হাসিবুর রহমান মানিক মাইক হাতে নিলে তার কর্মীরা শান্ত হয়। এসময় হাজী সেলিমের ছেলে সোলায়মান সেলিমের সমর্থকরাও আনিস বিরোধী নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় আনিস সোলায়মান সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সোলায়মান সেলিম মাস্তানি করবেন না। আপনার চেয়ে বড় মাস্তান মঞ্চে আছে। স্লোগানধারী নেতাদের উদ্দেশে বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ঘরে থাকতে দেওয়া হবে না। ঘুমাতে দেওয়া হবে না।
বিকাল চারটার দিকে মঞ্চে আসেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। বিশৃঙ্খল পরিবেশ দেখে নেতাকর্মীদের শান্ত থাকতে নিদের্শ দেন। কিন্তু কর্মীরা বিভিন্ন নেতার নামে স্লোগান দিয়েই যাচ্ছিলেন। এসময় উত্তেজিত কণ্ঠে হুমায়ুন কবির স্লোগানধারী কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই ... (প্রকাশ অযোগ্য), থাম। স্লোগান বন্ধ কর।’ পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম মহানগর নেতাদের উপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী মাইক নিয়ে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন।
বক্তব্য দিতে উঠে বিশৃঙ্খলা দেখে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, লাফালাফি, বাড়াবাড়ি করবেন না। নির্বাচনের ১৪ মাস বাকি অথচ শোডাউন দিয়ে শক্তি প্রদর্শন শুরু করেছেন। আপনারা কেউ সংসদ সদস্য (এমপি) হতে পারবেন না, নেতা হতে পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, লালবাগের রাজনীতিতে বহুমাত্রিক গ্রুপিং আছে। আমাদের (সভাপতি-সম্পাদক) আসতে দেরি হওয়ায় কিছুটা হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা ঘটেছে। স্লোগানধারী কর্মীদের গালি দেওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি।
পুুলিশ দিয়ে কর্মীদের শায়েস্তা করার হুমকি দাতা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য আনিসুর রহমানকে একাধিক ফোন ও এসএম করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল