১১ জানুয়ারি, ২০২১ ১০:৫৭

যেভাবে উত্থান দোকান বাণিজ্যের মাফিয়া কাউন্সিলর রতন

অনলাইন ডেস্ক

যেভাবে উত্থান দোকান বাণিজ্যের মাফিয়া কাউন্সিলর রতন

ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ রতন। ফাইল ছবি

রাজধানীর গুলিস্তানের দুই মার্কেটে অবৈধ দোকান নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এসব অবৈধ দোকান বাণিজ্যের মাফিয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ রতন। তিনি ‘ম্যাজিক রতন’ নামেও পরিচিত।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সুন্দরবন স্কোয়ার সুপার মার্কেটে নকশাবহির্ভূত অবৈধ ৭৫৭টি দোকান নির্মাণ করেছেন। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে নির্মাণ করেছেন ৪০০ অবৈধ দোকান। এসব দোকান বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। আর তার এই অপকর্মের সহযোগী একই ওয়ার্ডের যুবলীগের সাবেক সভাপতি সাহাবুদ্দিন। ৪ জানুয়ারি বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় সাহাবুদ্দিন গ্রেফতার হয়ে এখন জেলহাজতে। 

কাউন্সিলর রতন জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এন এন বিল্ডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়ক, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করেন। দেড় বছর আগেও অস্ত্রধারী দুজন দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতেন। নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার দাপটে তটস্থ থাকতেন। 

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আড়ালে চলে যান কাউন্সিলর রতন। কয়েক মাস পর প্রকাশ্যে এলেও দেহরক্ষী সঙ্গে রাখা বাদ দিয়ে দেন। গত বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন দুটি মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান শুরুর পর আবারও আলোচনায় এসেছেন তিনি। 

জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ফেনীর সোনাগাজী থেকে ঢাকায় এসে আড়াই দশকের মধ্যেই বিপুল সম্পদের মালিক বনে যান কাউন্সিলর রতন। অভিযোগ পাওয়া যায়, গুলিস্তানে ডিএসসিসির মালিকানাধীন সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে নকশাবহির্ভূত অবৈধ দোকান বৈধ করে দেওয়ার আশ্বাসে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়েছেন। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর থেকে এই মার্কেটে অভিযান চালায় ডিএসসিসি। 

অভিযানের প্রথম দিনই ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের জানান, অবৈধ দোকান বৈধ করে দেওয়ার নামে তাদের কাছ থেকে কাউন্সিলর রতন ও সাহাবুদ্দিন কয়েক লাখ করে টাকা নিয়েছেন। এই অভিযোগ পাওয়ার পর ওইদিনই সন্ধ্যায় কাউন্সিলর রতনকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দেন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। গত ২৮ ডিসেম্বর সেই নোটিসের ৫৬ পৃষ্ঠার জবাব দিয়েছেন কাউন্সিলর রতন। জবাবে তিনি মার্কেটে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করলেও নিজেকে ‘নিষ্কলুষ’ বলে দাবি করেছেন। 

গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুন্দরবন স্কোয়ার সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সাবেক সভাপতি সাহাবুদ্দিন। তখন তার ক্ষমতার নেপথ্যে ছিলেন রতন। সাহাবুদ্দিন ও তার অনুসারীরা মার্কেটের নিচ থেকে চারতলা পর্যন্ত টয়লেট ও লিফটের জায়গায় অবৈধভাবে দোকান তৈরি করেন। 

এছাড়া চারতলা ভবনের ওপর অবৈধভাবে আরেক তলা বানিয়ে সেখানে ৩০৪টি দোকান তৈরির পর তা বিক্রি করে দেন। পাঁচতলায় নির্মিত প্রতিটি দোকান ৬ থেকে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। আর নিচ থেকে চারতলা পর্যন্ত তৈরি দোকানগুলো বিক্রি করা হয় প্রতিটি ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকায়। 

এসব অবৈধ দোকান নির্মাণের ঘটনায় ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি সরেজমিন তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দেন ডিএসসিসির তৎকালীন উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার, কর কর্মকর্তা দেওয়ান আলীম আল রাজী, উপ-কর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও বাজার সুপারভাইজার সিদ্দিকুর রহমান। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবন মার্কেটের নিচ তলা, দ্বিতীয় তলা, তৃতীয় তলা ও চতুর্র্থ তলায় বিভিন্নস্থানে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সুন্দরবন স্কোয়ার সুপার মার্কেট মালিক সমিতি। ওই জিডিতে বলা হয়, সাহাবুদ্দিনসহ কয়েকজন যোগসাজশে মার্কেটের ১২টি চলন্ত সিঁড়ি গ্যাস কার্টার দিয়ে কেটে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। 

এ ছাড়া বৈদ্যুতিক জেনারেটর, বৈদ্যুতিক ৫০০ কেভিএ ট্রান্সফরমার ও পাওয়ার ফ্যাক্টর যন্ত্র লুট করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। এগুলো মূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকা। ওইসব যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়ে সেই জায়গায় অবৈধ দোকান নির্মাণ করেন। এমনকি টয়লেট ভেঙে অবৈধ দোকান নির্মাণ করে প্রায় ২৫ কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। কেউ এসব অপকর্মে বাধা দিলে তাদের মামলায় জড়ানোসহ প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। 

সুন্দরবন স্কোয়ার সুপার মার্কেটের দোকান মালিকরা জানান, একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত নকশার বাইরে অবৈধ দোকান বানিয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন ও তার অনুসারীরা। আর অবৈধভাবে পাঁচতলা বানিয়েছেন কাউন্সিলর রতন। সুন্দরবন স্কোয়ার সুপার মার্কেট ছাড়াও গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারেও (পোড়া মার্কেট নামে পরিচিত) অবৈধ দোকান তৈরি করে তা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

গত বছরের ২৯ অক্টোবর ডিএসসিসির মেয়রের কাছে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগও দিয়েছেন ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। মালিক সমিতির লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতি তলায় লিফট ও টয়লেটের জায়গা দখল করে ৪০০ অবৈধ দোকান তৈরি করা হয়েছে। এসব দোকানের মধ্যে ২০০টি দোকান ‘মেয়র কোটার’ কথা বলে বিক্রি করেছেন কাউন্সিলর রতন। এর মাধ্যমে তিনি ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা কাউন্সিলর রতনের শোকজের জবাব পর্যালোচনা করছি। জবাবটি পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে জানানো হবে।

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর