সম্প্রতি স্থানীয় একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০টি কোম্পানির নামে প্রদত্ত ঋণ ১৫ বছর মেয়াদি পুনঃ তফসিলের আবেদন অনুমোদন করেছে। এই ৫০টি কোম্পানির মধ্যে দেশের অনেক বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আছে। অনুমোদিত ৫০টি ঋণগ্রহীতা কোম্পানি মাত্র ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট প্রদান করে সব ঋণ ১৮ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করে নিতে পারবে। এই পুনঃ তফসিল সুবিধা গ্রহণের জন্য তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এই ৫০ কোম্পানির ঋণ পুনঃ তফসিলের অনুমোদন ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ কর্মসূচির প্রথম ধাপের সিদ্ধান্ত। আরও এক হাজার ঋণগ্রহীতা কোম্পানির অনুরূপ আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে সক্রিয় বিবেচনাধীন, যা দ্বিতীয় ধাপের সিদ্ধান্ত হবে। দ্বিতীয় ধাপের সিদ্ধান্তের বিবেচনায় সেসব কোম্পানি রাখা হয়েছে, যাদের মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি। দেশের ঋণগ্রহীতাদের এই বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—(১) করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনীতির মন্দাবস্থা, (২) ডলার সংকট এবং উচ্চ সুদের হার, (৩) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা এবং (৪) দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিশেষ সিদ্ধান্ত মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন দেশের ব্যবসায়ীরা বা ঋণগ্রহীতারা খুশি হয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা কিছুটা হতাশ হয়েছেন। এটিই স্বাভাবিক। কেননা এই সিদ্ধান্ত যাদের পক্ষে গেছে; যেমন—ব্যবসায়ী, বিশেষ করে ঋণগ্রহীতারা এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন।
পক্ষান্তরে যারা দেশের ব্যাংকিং খাত এবং অর্থনীতিতে এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে চিন্তিত, তারা এ ধরনের সিদ্ধান্তে কিছুটা অখুশি হয়েছেন। সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে যে অবস্থানই থাকুক না কেন, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অন্তত এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি নিয়ে ইতিবাচকভাবে ভাবতে শুরু করেছে।
ঋণ পরিশোধ বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেখানে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। প্রথমত, নামমাত্র ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিধান রাখার হেতু কী, তা মোটেও পরিষ্কার নয়।
তা ছাড়া ডাউন পেমেন্টের অর্থ কীভাবে ব্যবহৃত হবে, অর্থাৎ ঋণের আসল, না সুদ পরিশোধের জন্য ব্যবহৃত হবে, তা মোটেই পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত, কীভাবে পুনঃ তফসিলের মেয়াদ ১৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা-ও স্পষ্ট নয়। এই মেয়াদ কেন ২৫ বা ১০ বছর না হয়ে ১৫ বছর করা হয়েছে, সেই ব্যাখ্যাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড কি এই ১৫ বছরের অন্তর্ভুক্ত না অতিরিক্ত, সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তৃতীয়ত, কিস্তির ধরন কেমন হবে, অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা কি তাদের ইচ্ছামতো যখন যেমন পারেন সেভাবে পরিশোধ করবেন, নাকি মাসিক, ত্রৈমাসিক বা ষাণ্মাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করবেন, তার উল্লেখ নেই। চতুর্থত, পুনঃ তফসিলের পর ঋণের অবস্থা কেমন হবে। স্বাভাবিকভাবেই ভালো ঋণ হিসেবেই গণ্য হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে যখন নিয়মিত কিস্তি পরিশোধিত না হবে, তখন পুনঃ তফসিল করা ঋণ পুনরায় খেলাপি ঋণে পরিণত হবে কিনা, তার উল্লেখ নেই। পঞ্চমত, পরিশোধিত কিস্তির টাকা ঋণের আসল, না সুদ পরিশোধে ব্যবহৃত হবে, সেটিও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ্য, যদি পরিশোধিত কিস্তির অর্থ প্রথমেই আসলের পরিবর্তে সুদ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়, তাহলে ঋণগ্রহীতা বা ব্যাংক, কেউই এই বিশেষ ব্যবস্থা থেকে লাভবান হতে পারবে না। ষষ্ঠত, পুনঃ তফসিলের সুযোগ নেওয়া ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ বরাদ্দ করা হবে কিনা, তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যবসা সফলভাবে চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে যাদের নতুন ঋণের প্রয়োজন হবে, তাদের যদি সেই সুবিধা দেওয়া না হয়, তাহলে ব্যবসা থেকে নগদ প্রবাহ হ্রাস পাবে, যার ফলে ঋণের কিস্তি পরিশোধে তারা ব্যর্থ হবেন এবং ঋণ পুনরায় খেলাপি হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে পুনঃ তফসিল করা ঋণের ওপর সুদের হার কত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীকে ঋণ পরিশোধ বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা একটি বিশেষ ব্যবস্থা। আর এই বিশেষ ব্যবস্থার অধীনে যদি বিশেষভাবে স্বল্প সুদের হারের সুযোগ না থাকে, তাহলে এই ব্যবস্থা কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। আমাদের দেশে এখন উচ্চ সুদের হার বিরাজ করছে। সুদের হার যদি ১০ শতাংশ বা তার বেশি থাকে, তাহলে বর্তমানে যে ঋণের পরিমাণ আছে, তা নির্ধারিত ১৫ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় তিন গুণ হবে, যা পরিশোধ করার সক্ষমতা বিশ্বের কোনো ব্যবসায়ীর থাকবে না, তাতে তিনি যত লাভজনক ব্যবসাই পরিচালনা করুন না কেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিশেষ সিদ্ধান্ত সফল করতে হলে পুনঃ তফসিল করা ঋণের ওপর সুদের হার কোনো অবস্থায়ই ৮ শতাংশের ওপরে রাখা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে এই ব্যবস্থাকে সহায়তা করার জন্য বিশেষ তহবিল সংগ্রহ বা সরকারি নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে সিকিউরিটাইজেশন শুরু করা যেতে পারে। বিষয়টি কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু উদ্যোগটি বিস্তৃত পরিসরে গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় স্পষ্ট করতে পারলে পদক্ষেপটি ভালো ফল দিতে পারে। এ ব্যাপারে যেসব বাড়তি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—(১) ৫০ বা এক হাজার নির্দিষ্ট কোম্পানির জন্য নির্ধারিত না রেখে উদ্যোগটি সর্বজনীন করা প্রয়োজন। এখন যেভাবে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে, তাতে পক্ষপাতমূলক অবস্থান স্পষ্ট। একটি সাধারণ নীতিমালা গ্রহণ করে সেখানে কিছু নির্ধারিত শর্ত রাখা যেতে পারে। ছোট-বড়-নির্বিশেষে যে কোম্পানিই এই শর্ত পূরণ করবে, তারাই এই সুবিধা নিতে পারবে। (২) এই সুবিধা নেওয়ার জন্য ৫০ কোটি টাকার ঋণ নির্ধারণের পরিবর্তে ব্যবসা চালু রাখার শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ ঋণের পরিমাণ যাই হোক না কেন, যাদের ব্যবসা চালু আছে, তারাই এই সুযোগ নিতে পারবেন। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, তারা এই সুযোগ নিয়ে কোনো রকম লাভবান হতে পারবেন না। এ রকম ঋণখেলাপির বিষয়টি ভিন্নভাবে সমাধান করতে হবে। (৩) কিস্তির টাকা দিয়ে প্রথমেই সুদ পরিশোধের সুযোগ রাখা ঠিক হবে না। সঠিক অবস্থা হচ্ছে, প্রথমে আসল পরিশোধ এবং পরে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা দিয়ে সুদ পরিশোধ করা যাবে। একই সঙ্গে পুনঃ তফসিলের পর এই ঋণের ওপর অর্জিত সুদ মুনাফা হিসেবে দেখানোর সুযোগ রাখা যাবে না। ঋণের আসল সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ হওয়ার পরই অর্জিত সুদ ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো যেতে পারে। এ রকম আরও কিছু বিষয় আছে, যা এখানে উল্লেখ করার সুযোগ সীমিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা প্রয়োজন, যাতে কোনো রকম অপপ্রয়োগ বা প্রভাব খাটানোর সুযোগ না থাকে। যদি উল্লিখিত বিষয়গুলো সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত বা সমাধান করে উদ্যোগটি বিস্তৃত আকারে গ্রহণ করা যায়, তাহলে এখান থেকে ভালো কিছু নিশ্চয়ই হবে। নতুবা এই উদ্যোগ দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সমস্যা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধ বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বেশ বিস্তৃত পরিসরে গ্রহণ করতে পারে।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা