লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মেঘনার ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারন করছে। বসতবাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলমসজিদ নদী গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চোখের সামনে নদী ভাঙ্গছে, বিলীন হচ্ছে-চিরচেনা বসতভিটা-ফসলি জমি। এ ভাঙ্গন দেখে কাঁদছে নদীর তীরে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি।
এক সময়ের বিত্তশালীরাও মেঘনা নদীর ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে এখন চরম অসহায়। তাদের মাথা গোজার জায়গা নেই। সবার চোখে-মুখে আতংক, আর্তনাদ। দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ প্রতিদিনই আসছে মেঘনার ভাঙনের তান্ডব দেখতে। প্রায় তিনশ বসতবাড়ী, ২শ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তিনটি প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, দুইটি মসজিদ ও অসংখ্য মাছের আড়ৎ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
প্রায় ১৫দিন আগে মেঘনা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি, স্কুল শিক্ষার্থী, বাজার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জেলে পরিবারসহ ৫শতাধিক গ্রামবাসী নদীর তীরে মানব বন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। এমন চিত্র লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী, দক্ষিন চরবংশী, উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
স্থানীয়রা বলছে, দ্রুত পাউবো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মোল্লার হাট বাজার, মসজিদ, স্কুল, বসতিঘরসহ রায়পুর উপজেলার দক্ষিন চরবংশী ইউনিয়ন, উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের অংশবিশেষ উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। আর পাউবো বলছে, দুই বছর আগে ভাঙনরোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে নোটশিট পাঠালেও এখনো তা অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ কারণে তাদেরও অসহায় হয়ে ভাঙন দেখা ছাড়া কিছু করা যাচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলছে, দ্রুত পাউবো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে রায়পুর উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। আর পাউবো বলছে, গত চার বছর আগে পানি সম্পদ মন্ত্রী সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন এবং দক্ষিন চরবংশীর মোল্লারহাট ইউনিয়ন পরিষদের সামনে সংক্ষিপ্ত সভায় তিন মাসের মধ্যে ভাঙ্গনের প্রতিরোধ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। কিন্তু আজও কোন খবর নেই। প্রায় দু’শত পরিবার, দুটি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ ও দুই শতাধিক বাজার ব্যবসায়ী চরম আতংকে দিনাতিপাত করছে।
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত পাঁচ বছর ধরে নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরবর্তী উপজেলার দক্ষিন চরবংশী ইউনিয়নের মোল্লার হাট, পানিরঘাট, স্নুইসগেট এলাকা, উপজেলা চেয়ারম্যান ঘাট এলাকা, হায়দরগঞ্জ সাইজ উদ্দিন মোল্লার ঘাট এলাকা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকার ছয়টি গ্রামের সহস্রাধিক বসতভিটাসহ কয়েকশ হেক্টর জমি ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
চরবংশীর মোল্লারহাট, স্নুইসগেট, হাজীমারা, জালিয়ার চর, টুনুরচর ও চরঘাশিয়া গ্রামে চলছে মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন। একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসত বাড়ি ও ফসলি জমি। ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশে মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেকে। বাপ-দাদার চিরচেনা বসতভিটা, ফসলি জমি হারিয়ে অনেককে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাতের বেলায় ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে নদী তীরবর্তী লোকজন ।
চরবংশীর মোল্লারহাট গ্রামের মোঃ সোবহান বকাউল, মোঃ সেলিম মিয়া, মিজানুর রহমান প্রধানিয়া, মনির হোসেন মাঝি, আব্দুর রহিম ঢালী বলেন, মাত্র পাঁচ বছর আগে আমাদের সাজানো বাড়ী, বাগান, পুকুর, মাছের ঘের সবকিছু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এক কিলোমিটার পেছনে এসে নতুন করে আবার বাড়ি নির্মাণ করেছিলাম। সেটিও বিলীন হয়ে গেল। এখন আমরা চরম অসহায়। গত দুই বছর আগে পানিসম্পদ মন্ত্রী ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করে তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু তাদের আশ্বাস থেকেই গেল, আর আমাদের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেল।
দক্ষিন চরবংশী ইউপি চেয়ারম্যান আবু ছালেহ মোঃ মিন্টু ফরায়েজী জানান, নদী ভাঙনের ভয়াবহতা এতো বেশি যে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়ি অথবা স্থাপনা নদীতে চলে যাচ্ছে। এই বিষয়ে উর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েও কোনো ফল না পেয়ে আমরা হতাশ।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান বলেন, পাঁচ বছর আগে থেকেই হাইমচরের চরভৈরবী থেকে রায়পুর হয়ে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর ঘাট পর্যন্ত ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। গত দুই বছর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় বহু বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যায়। এ কারণে গত দুই বছর আগে পানিসস্মপদ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা এলাকা পরিদর্শন করে তীররক্ষা বাঁধের আশ্বাস দেন। এরপরই কারিগরি কমিটি স্থান পরিদর্শন করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কিন্তু সেটি অনুমোদন হয়নি। অনুমোদনের পর প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হবে। তারপর পাস হলে স্থায়ী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এটি সময়সাপেক্ষে ব্যাপার। কিন্তু এ বছর যে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে তা থেকে জনপদ রক্ষায় একমাস আগে জরুরি বরাদ্দ চেয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বোর্ড থেকে অনুমোদন হয়নি। এ কারণে আমরা কোনো কাজ করতে পারছি না। আমাদের শুধু পরিদর্শন করে দেখা এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর