জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব ও বড়াল নদীর উৎসমুখে যত্রতত্র স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে পলি জমে অস্তিত্ব সঙ্কটে শত বছরের ঐতিহ্যের ধারক চলনবিল।
অপরিকল্পিত বাঁধ, সেতু, কালভার্ট সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ, দখল ও দূষণে বিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।শুষ্ক মৌসুমে বিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৭৭টি নদী, বিল, খাড়ি ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে রপান্তরিত হয়েছে। এতে বিল-নদী নির্ভর প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে দিগন্ত বিস্তীর্ণ বিলাঞ্চলের ফসল আবাদ গভীর-অগভীর নলকুপ নির্ভর হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, দেশের বৃহত্তম এ বিলের পানি চলমান হওয়ায় এ বিলের নামকরণ করা হয় চলনবিল। বড়াল নদীর উৎসমুখে স্লুইসগেট ও শতাধিক ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করায় চলনবিলের নদী-বিল-খাড়ির অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শতাধিক ফ্লাসিং ইনলেটের জালে জড়িয়ে অখণ্ড চলনবিল এখন বহু ভাবে বিভক্ত। এতে চলনবিলের মৎস্য সম্পদ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা জাল দলিল তৈরি করে দখলে নিয়েছে বিলের কয়েক হাজার একর খাস জমি।
ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা গেছে, চলনবিল অঞ্চলে ৩৯টি বিল, ১৬টি নদী এবং ১২০২২টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মতো বড় বড় পানির আধার ছিল। যান বেশির ভাগই বেদখল ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, বর্তমানে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার এক হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। মোট লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে জমির পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে।
চলনবিলের তিনটি জেলা নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে বেশিরভাগ খাস জমি ও জলাশয় এখন এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। শুষ্ক মৌসুমে চলনবিলের নদী বিল শুকিয়ে জেগে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। স্থানীয় কৃষকরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজসহ নানা রকমের ফসল আবাদ করছেন। এসব নদী-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এক সময়ের অতি পরিচিত দেশি ৬৫ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো মাছের বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, এক সময় বড়াল, নন্দকুজা, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, ফুলজোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ও গোয়ালা নদীসহ অসংখ্য বিল ছিল চলনবিলের গর্ব ও ঐতিহ্য। এছাড়া নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউলার খাল, নিমাইচরা- বেশানী, বেশানী-গুমানী ও উলিপুর-মাগুড়া, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গাঁড়াবাড়ি-ছারুখালী খাল, জানিগাছার জোলা ছিল চলনবিলের প্রাণ। কিন্তু ধীরে ধীরে এসব নদী-বিল ও খাড়ি ভরাট হয়ে যাওয়ায় মৎস্য ও জলজসম্পদে ভরপুর চলনবিলে এখন মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এক সময় চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের মানুষ।
১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ নির্মিত হলে চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে এ বিলের মাছ ট্রেনে করে ভারতে রফতানি হতো। ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চীরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাব খাটিয়ে এসব নদী দখল করছে। ফলে নদী সংলগ্ন এলাকায় ফসলহানি, বদ্ধ পানিতে দূষণ-দুর্গন্ধ-রোগবালাই, জেলে-কৃষক, ব্যবসায়ী-বেকাররা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভূমি দস্যুরা দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে নদী তীরবর্তী জেলে, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেকার বানিয়ে নদী ধ্বংসের অপকর্মে নেমেছে। ব্যবস্থাপনার নামে অকেজো হয়ে পড়া স্লুইসগেটগুলো এখন সরকারি টাকা অপচয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জেনে-শুনে সংশ্লিষ্ট বিভাগ নীরব রয়েছে। চলনবিলের নদীগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন নদীর তীরবর্তী মানুষ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ২৫ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও বিলে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা থাকতো। ফলে সারা বছরই নৌ চলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী-বিল ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে এবং ১৯৮০ দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ, ভূমি দখল করে বসতি ও দোকানপাট স্থাপন করায় নদী ও বিলগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বড়াল নদীর উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে পলি জমে চলনবিল এখন অস্তিত্ব সংকটে। অপরিকল্পিত বাঁধ, সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ, দখল ও দূষণে বিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন