ট্যাক্সিডার্মি হলো মৃত প্রাণীকে জীবন্ত প্রাণীর মতো সংরক্ষণের আধুনিক কৌশল। এই কৌশল রপ্ত করে অসামান্য কীর্তি গড়েছেন মো. দেলোয়ার হোসেন। বাংলাদেশে প্রথম সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া ট্যাক্সিডার্মি করেছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি মৃত ক্যাট বেয়ার ট্যাক্সিডার্মি করেছেন চিড়িয়াখানার সংগ্রহশালার জন্য...
এখন মো. দেলোয়ার হোসেন আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে কর্মরত। দেলোয়ার হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০১-২০০২ সেশনে একই বিভাগ থেকে কীটতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশে একমাত্র ব্যক্তি, যার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে গবেষণা রয়েছে। তিনি প্রফেসর সফিনুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ২০০৩ সালে “Prospect and Problem of Taxidermy” শিরোনামে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও জাদুঘরে যান। তখন তিনি নিশ্চিত হন যে, দেশে কোনো ডিগ্রিধারী প্রফেশনাল ট্যাক্সিডার্মিস্ট নেই। তবে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ/কোর্স বা অন্য কারও কাছ থেকে দেখে প্রাণী স্টাফিং করা অনেকেরই জানা ছিল। শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনে মৃত প্রাণী সংরক্ষণের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ড. মো. নুরুল ইসলামের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ছাত্রজীবনেই ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন মিউজিয়ামে আবেদন করেন। একপর্যায়ে ২০০৫ সালে কানাডা ও আমেরিকার কয়েকটি মিউজিয়াম থেকে তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অফার লেটার পাঠানো হয়। তবে আর্থিক সুবিধা বা অনুদানের ব্যবস্থা না থাকায় তিনি সেখানে আর যেতে পারেননি। দেলোয়ার এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক প্রাণীর ট্যাক্সিডার্মি করেছেন, যার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। দেলোয়ার প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যান ২০১২ সালে। তিনি এক বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে সেন্ট্রাল ভেটেরিনারি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি জার্মানিতে প্রশিক্ষণ নেন। এর মধ্যে প্রথম এক বছর তিনি ফ্রিডরিখ শিলার ইউনিভার্সিটি, ইয়েনা-এর জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর এরিক ফিশারের তত্ত্বাবধানে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, আরফুর্ট-এ হাতেকলমে কাজ শুরু করেন। সেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ট্যাক্সিডার্মিস্ট মি. মার্কো ফিশারের অধীনে তিনি ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তী দুই বছর তিনি ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, আনহাল্টের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর এরিক এন্টের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। এ সময়ে তিনি বার্লিন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, স্টুটগার্ট ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, স্ট্রালসুন্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, মেরিন মিউজিয়াম এবং ওসেনিয়ামে পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের প্রাণী সংরক্ষণের কলাকৌশল শিখে সফলভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ‘প্রফেশনাল ট্যাক্সিডার্মিস্ট’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ট্যাক্সিডার্মিতে দেলোয়ার দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন মিউজিয়ামে কর্মরত তরুণ ট্যাক্সিডার্মিস্টদের নিয়ে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে জার্মানির স্ট্রালসুন্ড শহরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ট্যাক্সিডার্মিস্ট কনফারেন্সে ছোট ও মাঝারি আকারের পাখির ট্যাক্সিডার্মি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ছোট পাখির ক্ষেত্রে তিনি প্রথম স্থান এবং মাঝারি আকারের পাখির ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ইতালির লংগারনোতে অনুষ্ঠিত নবম ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ট্যাক্সিডার্মিস্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে ছোট পাখির ট্যাক্সিডার্মিতে তিনি ৮৩% নম্বর পেয়ে রেড রিবন এবং মাঝারি আকারের পাখির ট্যাক্সিডার্মিতে ৯৫% নম্বর পেয়ে ব্লু রিবন অর্জন করেন, যা তার অন্যতম সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ আয়োজিত পাখিমেলায় তিনি ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রথম স্থান অর্জন করেন। গত কয়েক দশকে অসংখ্য ট্যাক্সিডার্মি করলেও দেলোয়ারের মতে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় একটি সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মৃত ঘোড়ার ট্যাক্সিডার্মি সম্পন্ন করা। বর্তমানে ঘোড়াটি সামরিক জাদুঘরের আর্মি গ্যালারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া দেলোয়ারের করা বিভিন্ন প্রাণীর ট্যাক্সিডার্মি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ মিউজিয়াম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ মিউজিয়াম, ইডেন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, পদ্মা ব্রিজ মিউজিয়াম, বিজিবি মিউজিয়াম (পিলখানা) এবং সামরিক জাদুঘর, বিজয় সরণিতে।